একটি সুসংহত রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমরা স্বাধীনতার সুফল ঘরে তুলতে পারিনি। বারবার আমাদের ওপর স্বৈরসাশনের ছোবল আসে। সর্বশেষ স্বৈর ছোবলে অসংখ্য ছাত্র-জনতার প্রাণ গেছে। তবুও আমরা দমে যাইনি। তবুও আমরা স্বাধীনতা চাই। মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানের স্বাধীনতা নয়। চাই সর্বসাধারণের স্বাধীনতা। চাই কোটামুক্তির স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের স্বাধীনতা। তাই আমাদেরকে এগোতে হবে আরো অনেক দূর। সবচেয়ে বেশি এগোতে হবে সম্ভবত শিক্ষা খাতে।
আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সনদ সবই আছে। কিন্তু যা নেই, তা হচ্ছে সুশিক্ষা। আমরা জ্ঞানকে পুস্তক থেকে বের করে এনে বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারিনি। আমরা বই-পুস্তকে পড়ি এক, আর আমাদের জীবন অন্য এক। বইয়ের সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনো যোগ নেই । আমরা জ্ঞান দিয়ে জীবন চালাই না। জ্ঞানকে আমরা পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসি। আর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন চালাই মূর্খতা দিয়ে; প্রথা দিয়ে; বিশ্বাস দিয়ে। সুশিক্ষার অনুপস্থিতি আমাদের সমস্ত সমস্যার মূল।
বন্যা আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা। আপাতদৃষ্টিতে বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে একে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলা ভালো। বিশেষ করে ঘন ঘন বন্যার দায় যতোটা না প্রকৃতির, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের, সুশিক্ষা বঞ্চিত অসচেতন নাগরিক গোষ্ঠীর।
শিক্ষা আমাদেরকে ভালোবাসতে শেখায়। একজন সুশিক্ষিত নাগরিক শুধু নিজেকে ভালোবাসে না। শুধু মানুষকে ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে সমস্ত জীবজগৎ, প্রকৃতি ও পরিবেশকেও। কিন্তু আমরা সুশিক্ষিত না হওয়ার কারণে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারি না। চেতনে-অবচেতনে প্রকৃতির ওপর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অন্যায় করে যাচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতি তো কাউকে ক্ষমা করে না। সে তার ওপর করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে। যখন নেয় তখন ভালোভাবেই নেয়। তাতে আমরা ভেসে যাই, উড়ে যাই এবং ধ্বংস হয়ে যাই। প্রকৃতির প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচতে আমাদেরকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। আমাদেরকে ভালোবাসা শিখতে হবে অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মূর্খরা ভালোবাসতে জানে না। মূর্খরা স্বার্থপর হয়। আত্মস্বার্থের মোহে অবচেতনেই তারা অন্যের ওপর অন্যায় করে। যেমন-একজন মূর্খ তার নিজের ব্যক্তি সুবিধার জন্য অবলীলায় যে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে তা অন্যের জন্য অর্থাৎ মানুষ জীবজন্তু কিংবা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। নিজের ভালো কমবেশি ইতর প্রাণিও বোঝে। কিন্তু অন্যের ভালো বোঝা সহজ নয়। তার জন্য তাকে মানুষ হতে হয়, অর্থাৎ সুশিক্ষিত হতে হয়।
শিক্ষা কোনো নিরীহ ব্যাপার নয়। শিক্ষা নিজেই একটি বৈপ্লবিক ধারণা, পুরোনোকে ভেঙে নতুন সত্যকে নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষা মানে সত্যানুসন্ধ্যান। সত্যের অনুসন্ধ্যানে নামলে দেশে মিথ্যা বা অপশাসন টিকতে পারে না। স্বৈরশাসককে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। তাই স্বৈর-শাসকেরা যুগে যুগে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ধ্বংসের আয়োজন করে থাকে। সাবেক স্বৈরশাসকও এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলো। তাতে ক্ষমতা টেকানো গেছিলো দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময়। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁক গলে যে সামান্য একটু শিক্ষার আলো সমাজে প্রবেশ করেছে তাতেই দুরাচারী শাসক পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে। যদি দেশে সুশিক্ষা বিস্তৃত করা যেতো তবে দেশ অনেক আগেই অপশাসন হটিয়ে একটি চমৎকার জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র পেতো। এবং জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পারতো।
অপশাসকেরা পরিকল্পিতভাবে যে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করে তাদেরকে সহজেই উন্নয়নের ধোঁকা দেয়া যায়। উন্নয়নের নাম দিয়ে ধূর্ত শাসকেরা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কিশোরগঞ্জের মিঠামাইন সড়কের মতো যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো, সেগুলো আসলে পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্প। হাওরের ভেতরে মিঠামাইন সড়কের নির্মাণে ওই এলাকার সাধারণ, অশিক্ষিত জনগণ সেবার খুশির জোয়ারে ভেসেছিলো। কিন্তু হাওরের স্বভাব ও প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে বানানো এই সড়ক যখন স্বাভাবিক পানি-প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে লাগলো, তখন ওই এলাকার জনগণ বন্যার পানিতে ভাসলো। তৎকালীন শাসক নিজেও পরে স্বীকার করেছিলো, এই রাস্তা নির্মাণ ঠিক হয়নি।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সাবেক স্বৈরশাসকেরা বছরের পর বছর ধরে যে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা নিশ্চয়ই পরিবেশ সচেতন নয়। এই অসচেতন নাগরিকেরা যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ও থুথু ফেলে; নির্বিচারে পলিথিন ব্যবহার করে; ব্যবহৃত পলিথিন ফেলে নদী ভরাট করে; বাড়ি নির্মাণ করতে নদী ভরাট করে। শেষে ভরাট হওয়া নদী বৃষ্টির পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত করে বন্যা সৃষ্টি করে। এই জনগোষ্ঠী তাদের আরাম ও ভাবের জন্য মোটরসাইকেলের মতো পরিবেশবিরোধী যানবাহন ব্যবহার করে পরিবেশকে কার্বন উপহার দেয়। তারা হাঁটতে জানে না। সাইকেল চালালে ইজ্জত যায়। এরা বাবু। অশিক্ষিত এই বাবু সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে দেশের জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী খুব দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে। অত্যধিক তাপে বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জলীয় বাষ্প মেঘ হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে ‘ভাসমান নদী’ বা ‘উড়ন্ত নদী’ বলে। এই ‘উড়ন্ত নদী’ বাষ্প ও মেঘের আকারে প্রচুর পানি ধারণ করছে। বৃষ্টি হয়ে এই পানি ভূ-পৃষ্ঠকে প্লাবিত করে বন্যা তৈরি করছে।
আমরা যদি সুশিক্ষিত হতাম, তবে পরিবেশ সচেতন হয়ে দেশকে রক্ষা করতে পারতাম। একটি রক্তক্ষয়ী ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অপশাসকের বিদায় জানিয়ে আমরা রাষ্ট্রে সুশাসন ও সুশিক্ষা বিস্তারের একটি সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার নেতৃত্ব এখন যে নোবেল বিজয়ীর হাতে তিনি বিখ্যাত ‘তিন শূন্যে’র পৃথিবী গড়ার প্রবক্তা। যেই তিন শূন্যের একটি হচ্ছে ‘শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ’। অর্থাৎ পরিবেশবাদী রাষ্ট্রনেতার নেতৃত্বে হয়তো আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দুর্যোগমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ ও নিরাপদ পৃথিবী উপহার দিতে পারবো।
লেখক: শিক্ষক, উজিরপুর, বরিশাল