শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়নের ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। উন্নত জীবনযাপন ও সমাজের অগ্রগতি আনয়নে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। একটি দেশের শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশে পরিচালিত হবে, কোন বিষয়বস্তু পাঠের মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে, কোন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তা শিখবে এবং শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনার সমষ্টিই শিক্ষাক্রম।
একটি দেশের শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয় মূলত সেই দেশের জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গড়া ও শিক্ষার্থীদেরকে কর্মে নিয়োজিতকরণের একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা থেকে। অর্থাৎ একটি জাতি তার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে কীভাবে গড়ে তুলতে চায় তাই হলো ওই জাতির শিক্ষা এবং শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য নির্ধারণে যে বিষয়গুলোতে সচেতনভাবে নজর দেয়া হয় তা হলো নাগরিকদের জাতীয় আদর্শ, সমাজের চাহিদা, শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি, মানসিক অবস্থা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবহারের ধরন, সামাজিক রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত, ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীর মানসিক ও সামাজিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ; দেশপ্রেমিক ও কর্তব্যনিষ্ঠা; মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক তৈরি, সৎ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন, পরমতসহিষ্ণুতা ও সংবেদনশীলতা; আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা ইত্যাদিকে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্ব দেয়া হয়।
স্বাধীণতার পরই ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম পরিবর্তন আনা হয় যা স্থায়ী হয়েছিলো প্রায় ১৯ বছর। এর পর ২য় বার পরিবর্তন আনা হয় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মুখস্থ নির্ভর এই কারিকুলামে প্রথমবারের মতো যুক্ত করাহয় নৈর্ব্যাক্তিক প্রশ্নের যা ১৭ বছর পর্যন্ত চলমান ছিলো। এই মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মেধা সঠিকভাবে যাচাইকরার কোনো সুযোগ ছিলো না, তাই মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাই করার লক্ষ্যে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যার ফলশ্রুতিতে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিক পরীক্ষা সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ৩য় বার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন আনা হয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবনযাপনে এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। কর্মক্ষেত্র ও কর্মধারায় পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে মনোজগতে এসেছে পরিবর্তন যার প্রভাব পড়েছে দৈনন্দিন জীবন প্রণালিতে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে অভিযোজিত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করে। আর এই রূপকল্পকে সামনে রেখে যোগ্যতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সর্বশেষ কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হলো-মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা। অর্থ্যাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি লালনকারী সৎ, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, আত্মবিশ্বাসী, দক্ষ, সৃজনশীল ও সুখী একটি প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্য নিয়েই তৈরি হয়েছে বর্তমান কারিকুলাম।
এই কারিকলামের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-শিক্ষার্থীরা প্রেক্ষাপট নির্ভর অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিমূর্ত ধারণা করে সক্রিয় পরীক্ষণে পৌঁছাতে পারবে। প্রকল্পভিত্তিক, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জভিত্তিক, অনুসন্ধানমূলক, সহযোগিতামূলক, সংযোগমূলক ও প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখন কৌশলের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ, হাতে-কলমে কাজ, দলীয় কাজ, পঠন ও স্মৃতিতে ধারণ করে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা অর্জনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, বিশ্বনাগরিকত্ব দক্ষতা, জীবিকায়ন দক্ষতা, মৌলিক দক্ষতা, ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
বর্তমান শিক্ষাক্রম নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী কারিকুলাম। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে হলে বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছিলো। কিন্ত শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের চেয়ে তা বাস্তবায়নকরা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। শিক্ষকেরা কোনো পরিবর্তন গ্রহণ করতে অভ্যস্ত না। তারা অভ্যস্ততার ভিত্তিতে ক্লাশ নিতে পছন্দ করেন। তাই তারা পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিক্ষাক্রমকে সহজে গ্রহণ করতে পারছেন না। তারা শিক্ষাক্রমের ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিক নিয়েই সমালোচনামূখর। তারা ভাবছেন এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বাসায় পড়তে হয় না, বাড়ির কাজ করতে হয় না, পড়ার চাপ নেই, প্রাইভেট কোচিং করতে হয় না, পরীক্ষা নেই, পরীক্ষার খাতায় লেখা নেই, ক্লাশে ফাস্ট, সেকেন্ড নেই তাই তারা ভাবেন এ আবার কেমন কারিকুলাম! এই অভিভাবকরাও আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, নোট-গাইডের বিশাল ব্যবসা ও কোচিং বাণিজ্য। নোট-গাইডের ব্যবসা ও কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যাক্তিরাও কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক মতপার্থত্য ও ধর্মান্ধতা। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিরোধী রাজননৈতিক দলগুলো সুদূর প্রসারী চিন্তা না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার জায়গা থেকেই বিরোধিতা করছেন যা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে বান্তবায়নে যে সকল দিকের প্রতি নজর দিতে হবে তা হলো: নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেকে কারিকুলামের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে এবং সকলের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান আরো উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে ইনহাউজ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদ্যালয়গুলো কারিকুলাম বাস্তবায়নে যথাযথভাবে কাজ করছে কি না তা তদারক করতে হবে। প্রয়োজনে মাস্টার ট্রেইনারদের দিয়ে দল গঠন করে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে এবং বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে অবশ্যই মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সংযুক্ত থাকতে হবে। বিশেষকরে প্রান্তিক এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে এই সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
শ্রেণি শিক্ষকদের অবশ্যই আইসিটি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে যেনো তারা মাল্টিমিডিয়ার ম্যাধমে ক্লাশ পরিচালনা এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
নতুন শিক্ষাক্রমে অনুযায়ী সকল বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হবে শ্রেণিকক্ষে অর্থ্যাৎ এখানে শিক্ষকদের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন শিক্ষাক্রমে বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকেরা তাই শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৫ এ নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫৫। এই অনুপাত বাজায় থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একক কাজ, জোড়ায় কাজ কিংবা দলীয়কাজ করানো সম্ভব নয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদেরকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।
যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে কিছু সমস্যা থাকতে পারে আর এই কারণে যদি আমরা পিছিয়ে থাকি, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাবেন, শিক্ষার্থীরা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে পারবেন না। তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক কাজের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যোগ্যতাভিত্তিক এই শিক্ষাক্রমের বিকল্প নেই। তাই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, রৌমারী সিজি জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম