কোনও জাতির উন্নতির প্রধান শর্ত হচ্ছে সুষ্ঠু নীতি, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। আবার কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে ধ্বংস করতে হবে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি । দুশো বছরের বৃটিশ শাসন, ২৫ বছরের পাকিস্তানী শাসন ও শোষণ এবং তারই ফলশ্রুতিতে আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা পেয়েছিলাম তা কোনক্রমেই আমাদের জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিলো না । ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে ২৬ ধারায় নাগরিকদের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করা হয় । অন্ততপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে । প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সব সদস্য রাষ্ট্রকে এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানায় । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সেটি তো বাস্তবায়ন করেইনি বরং ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পর প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধ্বংসের চক্রান্ত করে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে বাংলা ভাষাকে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২ এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ বিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।
এ সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় আর সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত।
৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যূত্থান, ১৯৭০’র নির্বাচন সর্বোপরি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে তৈরি হলো নতুন রাষ্ট্র- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রক্তঝরা দিনগুলোর সীমাহীন ত্যাগ ও কঠোর সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে ইংরেজ প্রবর্তিত ও পাকিস্তান আমলে প্রচলিত শিক্ষা যুগের চাহিদা পূরণ করতে যে সক্ষম নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সর্বমহল থেকে শিক্ষা সংস্কারের দাবি ওঠে। বাংলাদেশের জনগণকে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সত্যিকারের জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির নানাবিধ অভাব ও ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠনের নির্দেশনা এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে পরিচালনা করার পথ নির্দেশনার উদ্দেশ্যেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ মুহম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে কমিশনের প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানকল্পে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে কমিশনের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর পরিবর্তনের পর কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি।
এরপর সামরিক সরকারের আমলে একাধিকবার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর(খ) ধারার আলোকে একই ধারায় সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি হিসেবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন প্রজন্মকে দেশাত্ববোধে জাগ্রত করে গুনগত শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনুসারে ২০২৩ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ৩য়, ৪র্থ, ৮ম ও ৯ম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ৫ম ও ১০ম শ্রেণিতে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হবে। রূপকল্পের মূল লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। কী কী যোগ্যতা অর্জন করলে শিক্ষার্থীরা এই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে সেগুলোকে বিবেচনার কেন্দ্রে রেখে প্রাক-প্রাথমিক হতে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আর্ন্তজাতিক মানের লেখাপড়ার সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিখবে তার ওপর এ শিক্ষাক্রমটি বিশেষভাবে আলোকপাত করে।
এই শিক্ষাক্রম দেশজ মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং গৎবাধা ভাবনা ও সংস্কারকে প্রশ্ন করতে শেখায়। সহজলভ্য শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করে এবং স্বাধীনভাবে শিখতে সাহায্য করে। নতুন শিক্ষাক্রমে-পরীক্ষার চাপ নেই, রোল নং এর টেনশন নেই, ক্লাসের পড়া ক্লাসেই বুঝতে পারবে, প্রাইভেট ও কোচিং নির্ভরতা কমে আসবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষার্থীকে আর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে না। জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে সে কতটা পারদর্শিতা অর্জন করেছে তার ভিত্তিতেই তাকে মূল্যায়ন করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীকে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। বছরজুড়ে চলমান থাকবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। আর বছরে ছয় মাস অন্তর দুটি সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। পাঠ চলাকালীন সময়ে নির্ধারিত কাজ, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধান মূলক কাজ, মৌখিক উপস্থাপনা, রিপোর্ট তৈরি, মাঠ পরিদর্শন ইত্যাদি কাজে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম দেখে পারদর্শিতার সূচকে শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা নিরূপন করা হবে। এছাড়াও প্রত্যেক শিখন অভিজ্ঞতায় শিক্ষার্থীর সার্বিক আচরণগত দিক মূল্যায়ন করার জন্য তাদের আচরণগত সূচকের মাত্রা নির্ধারণ করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে জুন মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন ১ এবং ডিসেম্বর মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন ২ অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ব ঘোষিত এক সপ্তাহ ধরে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হবে। স্বাভাবিক ক্লাস রুটিন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য অর্পিত কাজ সম্পন্ন করবে।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও সফলতার জন্য সবার আগে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। এই প্রথম শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সহায়ক গাইড এবং বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন নির্দেশিকা সরবরাহ করেছে। যদি শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত নির্দেশনা, শিক্ষক সহায়ক গাইড, মূল্যায়ন নির্দেশনা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলেন তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম শতভাগ সফল হবে বলে আশা করা যায়|
আগের শিক্ষাক্রম ছিলো প্রতিযোগিতামূলক, আর নতুন শিক্ষাক্রম হচ্ছে সহযোগিতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে। যদিও অভিভাবকদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিলো যে, এই কারিকুলামে পরীক্ষা নেই কিন্তু বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সভার মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে জানার পরে তাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান হয়েছে এবং নতুন কারিকুলামকে খুব সহজভাবে নিয়েছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য অভিভাবকদের এ কারিকুলামের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। বছরের শুরুতে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি এবং ১ম ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া ছিলো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।
৬ষ্ঠ এবং ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে গেলে লক্ষ্য করা যায় প্রাণের স্পন্দন। নতুন কারিকুলামকে তারা খুব সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছেন। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষকতা নিছক একটি পেশা নয়, এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগ্রত করে গুনগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে এসডিজি-৪ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে আজকের শিক্ষার্থীকে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের উন্নত বিশ্বের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সব আয়োজন সার্থক হবে।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, মডেল একাডেমি, মিরপুর-১, ঢাকা