নতুন শিক্ষাক্রমে অবিভাবকদের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা এই যে, পরীক্ষা নেই তাহলে আমার সন্তানের পড়ালেখার কি হবে? কিন্ত পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভারাক্রান্ত না করে যেভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেটাকে ডকুমেন্টেড করা হচ্ছে, প্রোপার চ্যানেলে ইনফর্ম করা হচ্ছে। এরপর সরকারের মনিটরিং টিম মনিটর করছে। এসব অবশ্যই ভালো দিক। আমরা যে শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে যাচ্ছি সেটি কোলাবরেটিভ। এখানে সবাইকে অংশ নিতে হবে। শিক্ষার্থীর একার ওপরেই শেখার দায়িত্ব না, বা আমরা বলছি না যে গুণগত শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র একাই দায়িত্ব নেবে। জনগণকেই সরকারে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। অবিভাবককেও সন্তানের শিক্ষাকে দায়িত্বের সাথে
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষা-কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের সহকারী অধ্যাপক কাজী ফারুক হোসেন।
তিনি বলেন, আমাদের জাতির পিতা বলেছিলেন, শিক্ষা হলো মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার। সেটা কি ধরনের মুক্তি? বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা। অর্থাৎ সার্বিক উন্নয়নের জন্য একজন ব্যক্তির যতো ক্ষেত্রে বিকাশ প্রয়োজন তার সবটাই শিক্ষার মাধ্যমেই হয়। বর্তমান বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক দিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষাও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই সূচনার মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা হয়। শিক্ষার্থী কেনো বিদ্যালয়ে আসবেন? আমরা বলি যে- শিক্ষা তাই যা মানুষকে প্রাকৃতিক থেকে সামাজিক করে। শিশু যখন ছোট থাকে তখন সে প্রাকৃতিক থাকে। শিক্ষা দিয়েই তাকে সামাজিক করে তুলতে হয়। পরিবারের পরেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা সেই স্তর। সরকার কিন্ত প্রাক-প্রাথমিকের কোয়ালিটি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের চার নম্বর যে লক্ষ্য, যেটা শিক্ষা সম্পর্কিত, সেটা কিন্ত প্রাক-প্রাথমিক থেকেই শুরু হয়ে গেছে। এই শিক্ষাটা কিন্তু ভারাক্রান্ত শিক্ষা না। লেভেলটা এমনভাবে সজ্জিত হবে, এখন হয়তো সরকার বিভিন্ন সংস্থার সাথে এলাইন করে প্লে-বেইজ লার্নিংসহ অনেকভাবে সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা, প্রশিক্ষণ দেয়া, কমিউনিটিকে এনকারেজ করার কাজ করছে। এগুলোকে মনিটরিং যদি আরো শক্ত ভাবে করা যায় তবে ভালো।
কাজী ফারুক হোসেন বলেন, একজন শিশু একটা কবিতা মুখস্ত বলতে পারেন কিনা আমরা তা প্রত্যাশা করি না। আমরা প্রত্যাশা করি ওই লেভেলের শিশু তার প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য যা যা করতে হয় সেগুলো শিখবেন।
নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, যে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে যেখানে আপ টু গ্রেড থ্রি কোনো পরীক্ষা থাকবে না, তাদের গাঠনিক মূল্যায়ন হবে। হাতে কলমে দক্ষতা উন্নয়ন হচ্ছে কিনা, এই বয়সে যা শেখা দরকার শিক্ষার্থী তা শিখতে পারছেন কিনা তা বিভিন্ন টাস্কের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষকের পাশাপাশি অবিভাবককেও এখানে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সরকার এখনও আগের চেয়ে বেশি বেশি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম দক্ষতাভিত্তিক। আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে চাই। যেনো তিনি দেশের জন্য, নিজের জন্য বোঝা না হন।
কাজী ফারুক বলেন, আমাদের অনেক লিমিটেশন আছে- যেমন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ঘাটতি আছে, সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। যদিও সরঞ্জাম সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে, শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে, নতুন নতুন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এখানে অবশ্য সময় বা বাজেটের একটা ব্যাপার থাকে। এসব যথাসময়ে নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক সময় প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বায়াসনেস দেখা যায় যে, প্রধান শিক্ষক হয়তো একজনকেই বারবার পাঠাচ্ছেন তার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে বলে। এগুলো যেনো না হয়। প্রশিক্ষণ সব শিক্ষকেরই প্রয়োজন। ইনক্লুসিভ ক্লাসরুম, কোয়ালিটি এডুকেশনের কথা আমরা বলছি, আমরা ডিজিটাল ক্লাসরুম ব্যবহার করছি। সরকার ইতোমধ্যে স্কুল কলেজে আইসিটি গ্যাজেট সরবরাহ করেছে, অনেক স্কুলে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো ব্যবস্থাপনার কাজ যেনো সুচারুভাবে হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোর সংরক্ষণ যথাযথ হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং করতে হবে। সরঞ্জামগুলো নষ্ট হলে সেটার যেনো রিপেয়ার যথাসময়ে হয় হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বারবার যে জিনিসটা বলি সেটা হলো ছাত্র শিক্ষক অনুপাত, সেটা মেইনটেইন করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিক সেকশন করা, জনবল সরবরাহ করা, এ বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে যে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়নের কথা এসেছে সে জায়গায় আমাদের শিক্ষকদেরকে তৈরি করার একটা প্রয়োজনীতা আছে। আমাদের অবিভাকদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা আছে। একইসঙ্গে বিদ্যালয়ে অবিভাবকদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
সর্ব মহলকে শিক্ষায় একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অনেক সময় দেখি যে, একজন শিক্ষার্থী সামনের বেঞ্চে বসেছেন, শিক্ষক তাকে তুলে মাঝের বেঞ্চে বসালেন। অবিভাবক শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন যে, কেনো আমার ছেলেকে মাঝের বেঞ্চে বসালো। এটা শিক্ষক করেন ক্লাসরুম অর্গানাইজ করার জন্য। ক্লাসরুমের একটা কনসেপ্ট আছে যে, শিক্ষার্থীরা তার বন্ধুর কাছ থেকে শিখতে অনেক সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যতোটা না সে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন শিক্ষকের থেকে শিখতে। বন্ধুর সাথে নির্বিঘ্নে সবকিছু শেয়ার করতে পারেন, মন খুলে বলতে পারেন, শুনতে পারে। কারণ তিনি শিক্ষককে হয়তো ভয় পাচ্ছেন। এখানে শিক্ষককেও আবিষ্কার করতে হবে, কেনো ওই শিক্ষার্থী শিক্ষককে ভয় পাচ্ছেন। শ্রেণিকক্ষে ভীতিহীন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থী যেনো সকল ভীতি পরিহার করে শ্রেণিকক্ষে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে টিচিং-লার্নিয়ের জন্য শিক্ষক যে অর্গানাইজ করছেন তাও অবিভাবককে জানতে হবে। অবিভাবক যখন জানছেন না তখনই ভুল বোঝাবুঝিটা হচ্ছে। আমাদের এই গ্যাপটা কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই আমরা নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।