অতি সম্প্রতি নদী বিষয়ক অনেকগুলো দুঃসংবাদের ভেতরে দুটো সংবাদ বেশ আলোচনায়। এর একটি হলো- করতোয়া নদী ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেও প্রত্যাহার। অপরটি হলো- যমুনা নদী ছোট করার চিন্তা। পত্রিকায় প্রকাশিত এই দুটি রিপোর্ট পাঠ করলে সহজেই অনুমান করা যাবে নদী, সুরক্ষায় আমাদের অঙ্গিকার কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানতে পারছি, করতোয়া নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণের দায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘকে (টিএমএসএস) ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু পরে রায়ই বাতিল করা হয়েছে। ২০ মার্চ বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই সাজা দিয়েছিলেন ইউএনও ফিরোজা পারভীন। রায় ঘোষণার পর সংস্থাটির কর্মকর্তারা সেখানে হট্টগোল শুরু করলে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থতি শান্ত হয়। এর দুদিন আগে টিএমএসএস নদী ভরাট করছে এমন অভিযোগে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। ওই সময় নদীর সীমানা দখল করলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা দিতে রাজি থাকার মর্মে মুচলেকা দেন টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার নদীর সীমানা মাপা হয়। এ সময় অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে সংস্থাটির সিনিয়র সহকারী পরিচালক নজিবর রহমানকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে চাপের মুখে কিংবা অদৃশ্য কারণে সাজা ও জরিমানা দুটোই প্রত্যাহার করা হয়েছে।
যদিও সাজা বাতিলের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইউএনও বলছেন- নদী ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ এবং নির্দেশনা অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাওয়া টিএমএসএসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রধান সহকারী ও পেশকার রুহুল আমীন বলেন, জরিমানার টাকা না দেওয়ায় নজিবর রহমানকে আনা হয়েছিল। পরে সাজা বাতিল করা হলে তিনি মুক্ত হয়ে যান।
এর আগের সংবাদটি হলো, সরকারের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা চলছে যমুনা নদী ছোট করার। কিন্তু কেন? এর উত্তরে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য- ‘যমুনা নদী প্রতি বছর বড় হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার সময় নদীটি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এতো বড় নদীর প্রয়োজন নেই। তাই এটির প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস যমুনাকে ছোট করার এমন আইডিয়া এসেছে খোদ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের মাথা থেকে।
সংবাদপত্র সূত্রে আমরা জানতে পারি- এজন্য তারা ১১শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও প্রণয়ন করেছেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যখন বারবার ব্যয় সংকোচনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, সে সময় মন্ত্রণালয়টি এমন প্রকল্প নিয়েছে কোনো ধরনের গবেষণা ছাড়াই। যমুনা নদীর তীর রক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই অবকাঠামো শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভাঙন রোধে গাইবান্ধার ফুলছড়ি এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় যমুনা নদীতে টপ ব্লকড পারমিয়েবল গ্রোয়েন (টিবিপিজি) অর্থাৎ বাঁধ নির্মাণ করে প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ১০৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৮৯৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ২১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছর থেকে ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা দপ্তর) ড. শ্যামল চন্দ্র দাস বলেন, বর্ষার সময় যমুনা নদী ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এতো বড় যমুনা নদীর প্রয়োজন নেই। তাই নদীটাকে ছোট করতে (প্রস্থে) একটি পাইলট প্রকল্প ধরা হয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলো যমুনা নদী ব্যবস্থাপনা এবং নদীর প্রশস্ততা কমানো। যমুনা নদীর ফ্লো (প্রবাহ) কীভাবে কমানো যায় সেটি দেখা হবে। পাইলট প্রকল্প করে দেখা হবে নদী কতোটুকু কমানো যায়। এটি আসলে ধারাবাহিকভাবে কমানো হবে। প্রথমে ছোট আকারে শুরু হবে। যদি টেকসই হয় তাহলে পরে বড় আকারে প্রকল্প নেওয়া হবে।
গত ১৪ মার্চ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালিত হলো বাংলাদেশে। এ উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় নতুন করে নদীর সুরক্ষায় নানা ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা আমরা শুনেছি। সম্প্রতি ইকরিমিকরি আয়োজিত ফটো সাংবাদিক কাকলী প্রধানের তিন দিনব্যাপী ১০০ নদীর উন্মুক্ত আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বললেন, ‘নদী হলো আমাদের প্রাণ। নদী ঘিরেই আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে নদী ভরাট বন্ধ ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার, কোনো নদী অবৈধ দখলদারদের হাতে থাকবে না। নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে সারা দেশে ৮০টি ড্রেজারের মাধ্যমে ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। ডেল্টা প্ল্যান প্রকল্পের মাধ্যমে খাল, বিল, হাওর ও বাঁওড়ের খননকাজ করা হচ্ছে। নদী রক্ষার জন্য বর্তমান সরকারের নিদের্শনা অনুযায়ী ১০ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে এ পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর ঠিক দশ দিন পর ২০ মার্চ বিকালে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নদী রক্ষা করেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে। কোনোভাবেই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। দখল-দূষণের হাত থেকে নদী রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।’
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের এসব কথা শুনে আমরা দারুণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু পরক্ষণেই হতাশা গ্রাস করে। যখন দেখি চারদিকে নদী দখলের মহোৎসব বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং অবাধে বাড়ছে। বালু উত্তলন, দখল-দূষণ নিত্যদিনের সংবাদ। হয়তো এমন একটি দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেদিন নদীর ওপর অত্যাচারের সংবাদ আমরা শুনতে পাই না। অর্থাৎ নদীর প্রতি করা এসব অনাচার কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। তার মানে হলো, আমাদের সমস্ত আলাপ এখন বিলাপে পরিণত হচ্ছে। যখন দেখি খোদ নদীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী’ নিজেও চরম হতাশা ব্যক্ত করছেন। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকার লবনদহ নদী পরিদর্শন করে ভীষণ হতাশা প্রকাশ করে নিজের ফেসবুক আইডিতে তিনি একটি স্ট্যাটাস দেন। তাতে লিখেন, ‘ শ্রীপুর, মার্চ ১৬, ২০২৩। দখল-দূষণে বিপর্যস্ত লবনদহ নদী। যাকে এখন সরকারি কাগজপত্রে 'লবনদহ খাল' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে মাওনার কাছাকাছি গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় লবনদহ নদীর পাড়ে বিশাল বর্জ্যের স্তুপ। এলাকাটি শ্রীপুর পৌরসভার আওতাধীন। গত এক বছরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কর্মকর্তারা তিনবার এলাকাটিতে গিয়েছে। এমনকী কমিশনের কর্মীরা সারারাত এলাকাটিতে অবস্থান করে দূষণকারীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছে। কিন্তু লবনদহ নদীতে দূষণ বন্ধ হয়নি। শ্রীপুরের মেয়রকে বারংবার দূষণ বন্ধের আহবান জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা দখল-দূষণ প্রতিরোধের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয়। তাদের এই অবিমৃষ্যকারিতার দায় কে নেবে?’
যেখানে নদীর আইনি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান দখল-দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ফেসবুকে লেখেন- এই অবিমৃষ্যকারিতার দায় কে নেবে? তখন স্পস্টতই বোঝা যায় বিদ্যমান এই পরিস্থিতির আপাতঃ কোনো পরিবর্তন বা সমাধান সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে নদীপ্রাণ-প্রকৃতির ভবিষ্যত কী হবে সে প্রশ্নই সামনে আসে সবার আগে।
লেখক : ফয়সাল আহমেদ, সম্পাদক, রিভার বাংলা