গত বছরের ১৯ এপ্রিল কর্মস্থলে বের হন কুরিয়ার কর্মী নাহিদ হোসেন। দুপুরে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান মালিক-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের মাঝে পড়েন। এতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রায় এক বছর হতে চললেও এখনো দাখিল হয়নি চার্জশিট। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আটবার তারিখ দিয়েছেন আদালত। নাহিদ ছাত্রদের হাতে, নাকি ব্যবসায়ীদের হাতে খুন হন- দেখা দেয় প্রশ্ন। তবে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা কলেজের ছাত্রদের হাতেই খুন হন নাহিদ। গ্রেফতার আসামি মাহমুদুল হাসান সিয়াম লোহার রড দিয়ে নাহিদের মাথায় আঘাত করেন বলে তদন্তে সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) তারিকুল আলম জুয়েল জানান, তদন্ত চলছে। ঘটনাস্থলের সিসি টিভি ফুটেজ দেখে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিরা ঢাকা কলেজের ছাত্র। তদন্ত অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিরা হলেন- ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান সিয়াম, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স চতুর্থবর্ষের আব্দুল কাইয়ুম, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাহমুদ ইরফান, পলাশ মিয়া, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথমবর্ষের জুনাইদ বুগদাদী ও বাংলা বিভাগের ফয়সাল ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলাটির ঘটনাস্থলসহ আশপাশের ভিডিও ফুটেজ, স্থির চিত্র এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামি মাহমুদুল হাসান সিয়াম নাহিদকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করতে দেখা যায়। এছাড়া গ্রেফতারকৃত অন্য আসামিদের হাতে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র দেখা যায়। এদিকে এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি কতজন হবে এখনই বলা যাচ্ছে না জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমাদের তদন্ত চলছে। আরো আসামি করা হতে পারে। শেষ হলে বলা যাবে।
মামলার সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাহিদের মাথাসহ চার জায়গায় কাটা জখম রয়েছে। কপালের ডান পাশে, নাকের বাম পাশে, দুই হাতে বিভিন্ন জায়গায় ও পিঠে পাশাপাশি তিনটি কাটা জখম।
মামলার বিষয়ে আদালতে নিউমার্কেট থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. সাফায়েত বলেন, গ্রেফতার ৬ জন আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন।
এছাড়া প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ বার তারিখ দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলাটির প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।
স্বামীর পর শ্বশুরবাড়িও হারিয়েছেন ডালিয়া : এদিকে নাহিদ হত্যায় হাতে বিয়ের মেহেদী রং শুকানোর আগেই বিধবা হন তার স্ত্রী ডালিয়া। ঘটনার পর অনেকে ডালিয়াদের পাশে দাঁড়ালেও এখন খোঁজ নেয় না কেউ। স্বামী মারা যাওয়ায় শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তাকে। ১ মাস আগে ডালিয়ার কোলে নাহিদের এক মেয়ে সন্তান এসেছে। তবে এতে খুশির চেয়ে এতিম মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ডালিয়া।
তিনি বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হয়- ছেলে নেই, ছেলের বৌ দিয়ে কি করব। এরপর আমাকে বের করে দেয়। ১ মাস হলো আমার এক মেয়ে হয়েছে। এতে খুশির চেয়ে এতিম মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিনিয়ত চিন্তা করতে হচ্ছে। কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাদের দেখাশোনা বা কোনো খরচ দেয়া হয় না। প্রথমদিকে যারা সাহায্য করেছিল ওখান থেকে তিন ভাগে এক ভাগ দিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমার বাবা আরেক বিয়ে করে সেখানে থাকেন। তাই আরেকজনের বাসায় কাজ করা আমার মায়ের কাছে আমি বোঝা হয়ে আছি। সঙ্গে বৃদ্ধ নানিও থাকেন। আমার যদি একটা সরকারি চাকরি হতো, মেয়ের ভবিষ্যৎ হতো।
ডালিয়া আরো বলেন, আমাদের প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়ের তিন মাস পর আমাদের সংসার আলাদা করে দেয়া হয়। ৭ হাজার টাকা বেতনে তবুও আমাদের ভালো চলছিল। বিয়ের ৬ মাস পর ঘটনার দিন আমি অসুস্থ থাকায় স্বামীকে কাজে যেতে মানা করি। কিন্তু নাহিদ বলে, করোনার কারণে দেনা হয়ে গেছি। ঘর ভাড়া দিতে হবে। আর সামনে ঈদ, জামা কাপড় কিনতে হবে। এটাই ছিল তার শেষ যাত্রা। ছাত্ররা এভাবে একটা মানুষকে মেরে ফেলল। জন্ম নেয়ার পর আমার মেয়ে বাবার মুখ দেখতে পারল না। এতিম হয়ে গেল। স্বামীর মামলার অবস্থা সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না- জানান ডালিয়া। এদিকে নাহিদের পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, নাহিদ তিন ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম বড় ছেলে। অসচ্ছল পরিবারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই নেমে পড়েন কাজে। ডি-লিংক নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ‘ডেলিভারিম্যান’ ছিলেন নাহিদ। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল নিউমার্কেটে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শুধু নাহিদই নন, মোরসালিন নামে আরেকজন নিহত হন। নিউমার্কেট সংঘর্ষের ঘটনায় ওই দুই হত্যাসহ মোট চারটি মামলা হয়। বাকি দুটি মামলা পুলিশ বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলা দায়ের করে।