নির্যাতনে তোফাজ্জলের শরীর থেকে মাংস খসে পড়ে - দৈনিকশিক্ষা

নির্যাতনে তোফাজ্জলের শরীর থেকে মাংস খসে পড়ে

দৈনিকশিক্ষাডটকম, ঢাবি |

ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গিয়েছিল তোফাজ্জল হোসেন (৩০)। হলে চোর সন্দেহে তিন ধাপে নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। স্ট্যাম্প, রড, লাঠি দিয়ে মারার পাশাপাশি তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করে নির্যাতনকারীদের একজন। নির্মম নির্যাতনে তার শরীর থেকে মাংস খসে পড়ে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার রাতে হলে ঢুকলে চোর সন্দেহে তাকে ধরে ফেলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে তিন দফায় নির্যাতন করা হয়। হলের প্রত্যক্ষদর্শী একজন শিক্ষার্থী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি হল গ্রুপে ৮টার সময় দেখি হলে চোর ধরা পড়েছে। গেস্ট রুমে গিয়ে দেখি তিনি বসা। রুমে তখন ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারের অনেক ছেলে ছিল। গেস্টরুমে তাকে বেশি মারা হয়নি। ওখানে হালকা মারার পরে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে খাওয়ানোর জন্য। তারপর শুনি তাকে এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তখন ওখানে গিয়ে দেখি ২০-২১, ২১-২২ ও ২২-২৩ সেশনের ব্যাচ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জন। ফার্স্ট ইয়ার যে ব্যাচটা ছিল, ওরা মারেনি। ২০-২১ আর ২১-২২ সেশনের ওরা খুব বেশি মেরেছে।’

তিনি আরও জানান, ‘দুই-তিনজন মিলেই ওরে ওখানে মেরে ফেলছে। এরা হলেন-মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০-২১ সেশনের মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল, ফিরোজ ও জালাল। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। গেস্ট রুমে তার হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাকে। মারতে মারতে ও (তোফাজ্জল) পড়ে গেছে। এরপরে পানি এনে তাকে খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এ সময় সবাই হাততালি দেয়।’

ওই শিক্ষার্থী বলেন, সবাই খুশি হয় কারণ তাকে আবার মারতে পারবে। এরপর আবার শুরু হয় পেটানো। এই দফায়ও সবচেয়ে বেশি মেরেছে ফিরোজ। পরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের জালাল আসে। জালাল এসে আরও মারতে উৎসাহ দেয়; বলে ‘মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একেবারে’। এ সময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। পরে সুমন এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়।

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘পরে ওখানে স্যার (হলের আবাসিক শিক্ষক) আসেন। আমি ওদেরকে অনেক ফেরানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওরা মানেনি। এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্ট রুম থেকে যখন তাকে বের করা হয় তখন স্যার এসে পড়েছেন। মারধরে তোফাজ্জলের ডান পা এবং বাম পায়ের মাংস খুলে পড়ে গেছে তখন। অনেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। আমি বলি কাপড় আনো, ওর পা বেঁধে দেই। কারণ ব্লিডিং হলে তো সেন্সলেস হয়ে যাবে। পরে কাপড় এনে একটি জুনিয়র পা বেঁধে দেয়।’

ওই শিক্ষার্থী জানান, ‘মারধরকারীরা চেষ্টা করছিল মারধর করে তার স্বীকারোক্তি নেবে যে, চুরি হওয়া ফোন সেই নিয়েছে। মারধরের এক পর্যায়ে দু-তিনটি ফোন নম্বর দেয় তোফাজ্জল। সেই নাম্বারে ফোন দিলে অপর পাশ থেকে জানানো হয়, সে মানসিক বিকারগ্রস্ত। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা বিশ্বাস করতে চায়নি। সেখানে আসা শিক্ষকদের সামনেও তোফাজ্জলকে পেটানো হয়। শিক্ষকরা বাধা দিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।’

তিনি আরও জানান, ‘পরে তোফাজ্জলকে হলের মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরে জালাল প্রচুর মারে তাকে। বুটজুতা পরে এসে তোফাজ্জলের আঙুল মাড়িয়ে ছেঁচে ফেলে। আমি বলি, ভাই এগুলো কী করেন? তা শুনে হেসে দেয় জালাল। অনেকবার বলেছি, তারপরও সে বারবার হাতের আঙুল মাটিতে বিছিয়ে মাড়িয়েছে। তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করেছে জালাল। অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা এসে তাদের ফেরানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওরা কিছুতেই মানেনি।’ ঘটনা জানিয়ে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এত মারলে কেউ বাঁচতে পারে না। তার মাংসগুলো পড়ে গেছে। গোপনাঙ্গেও প্রচুর আঘাত করা হয়েছে।

মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই : ‘তোফাজ্জলের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। রাত ১১টার সময় আমার বাবাকে ফোন দেওয়া হইছে। আপনি কি তোফাজ্জলের মামা? আমার আব্বা ফোন ধরছে। তখন বলছে, ওরে (তোফাজ্জল) আমরা আটকাইছি, হলেই আছে, ওরে নিতে হলে টাকা দিতে হবে ৩৫ হাজার। ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে ওরে ছাড়াই নেন, না হলে আমরা ওরে ছাড়ব না, আরও মারব।’ বৃহস্পতিবার একটি বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলে সাক্ষাতে এ কথাগুলো বলছিলেন তোফাজ্জলের মামাতো বোন।

তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা বলল, আমি তো গ্রামের বাড়িতে, আমি কীভাবে কী করব। তখন আব্বা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, তুমি একটু কথা বলে দেখো। তোফাজ্জলকে হলে... কথা-বার্তায় অসঙ্গতি পাইছে। এজন্য ওরে ধরছে। ধইরা ওরে মারতেছে।’

‘পরে আমি ওই লোককে ফোন দিয়েছি, আমি তোফাজ্জলের মামাতো বোন, তাকে কেন মারছেন। ওরা বলছে, ও (তোফাজ্জল) আমাদের হলে ঢুকেছে। তখন আমি বলেছি, দেখেন ও তো পাগল মানুষ, যদি অন্যায়ও করে প্রশাসনের কাছে দেন। ওরে মাইরেন না। কিন্তু ওরা বলে, একটি পাগলের কীভাবে মামার নাম্বার মুখস্থ থাকবে। চাচাতো ভাইয়ের নাম্বারও মুখস্থ, তাহলে কীভাবে পাগল হয়?’

‘তখন বলেছি, তোফাজ্জল অনেক মেধাবী ছিল, ওর মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই বলতে গেলে। আমার ফুফু (তোফাজ্জলের মা) মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর মাথায় সমস্যাটা হয়েছিল। আপনি খাবার খাচ্ছেন, টান দিয়ে নিয়ে খাইল... ক্ষুধার জ্বালায় টাকা নিলো চেয়ে... এরকম। ওর বাবা মারা যায় রোড এক্সিডেন্টে ৮ বছর আগে। পাঁচ বছর আগে মা মারা গেছে লিভার ক্যানসারে। তারপর ছিল দুই ভাই। ভাই ছিল নাজিরপুর থানার এসআই, গত বছর রোজায় সেও ক্যানসারে মারা গেছে। ভাই মারা যাওয়ার পরে তোফাজ্জল একেবারে পাগল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, একজন খুনি হলেও তো জীবন্ত মেরে ফেলতে পারে না। একটি কুকুরকেও তো কেউ এভাবে মারতে পারে না।

বাড়িতে চলছে শোকের মাতম : তোফাজ্জল হোসেনের এমন মৃত্যুর খবর শুনে বরগুনার পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান আল ইমরান তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে বলেছেন, তোফাজ্জল হোসেন বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে বঙ্গবন্ধু ল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ অবস্থায়ই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। আরিফুজ্জামান আল ইমরান লেখেন, এই ছেলেটি বেশ স্বজ্জন, পরোপকারী ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ছাত্রনেতা ছিল। বিগত ২ থেকে ৩ বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনত সবাই সহযোগিতা করত। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে কুশল বিনিময় করত। আমি দেখা হলে ওরে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝেমধ্যে চেয়ে নিত। খাবার ও খাবার কেনার টাকার বাইরে ওর তেমন কোনো চাহিদা ছিল না।’

ইমরান আফসোস প্রকাশ করে লেখেন, ‘আহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! ছাত্র নামধারী বিবেকহীন এই নরপিশাচদের জন্য আজকে একটি নিরপরাধ প্রাণ চলে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলংকিত হলো। তোফাজ্জল হত্যার বিচার চাওয়ার মতো ওর পরিবারে অবশিষ্ট আর কেউ নেই। তবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার নিশ্চিত করতে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ে যাব।’ তোফাজ্জলের চাচা ফজলুল হক বলেন, তোফাজ্জলকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টিই শেখ পরিবারের নামে - dainik shiksha ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টিই শেখ পরিবারের নামে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে সিদ্ধান্ত জানালো বুয়েট - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে সিদ্ধান্ত জানালো বুয়েট ছাত্র কেনো প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে! - dainik shiksha ছাত্র কেনো প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে! শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তবুও তিনি উপাচার্য - dainik shiksha শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তবুও তিনি উপাচার্য পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিল - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিল পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব পদে আবারো ভাবী! - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব পদে আবারো ভাবী! দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036211013793945