দীর্ঘ সময় থেকে শিশু শিক্ষার্থীর হাতে নোট গাইড ব্যবহার হয়ে আসছে। অসাধু প্রকাশকরা ২য় শ্রেণি থেকে নোট গাইড প্রকাশ করে চলেছেন। আমি বিস্মিত, হতাশ হয়ে শুধু পত্রিকায় নিবন্ধ লেখে আসছি। এদেশের সুধীসমাজ, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা শুধু দেখে দেখে আসছেন। বেশিরভাগ পত্রিকা, আইনশৃঙ্গলা বাহিনী দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে সরব ভূমিকা পালন করে আসছেন। অথচ আজকের শিশু আগামী বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তাদের মেধা ধ্বংস করার, এ হীন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রায় সকলে সম্মিলিতভাবে নীরব।
শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে নোট গাইড সমাদৃত হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের হাতুড়ে পরীক্ষা ব্যবস্থা। এ পরীক্ষা জ্ঞানার্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিযোগীতামূলক পাসের ওপর। এ পাস শিক্ষার্থীর শারিরীক, মানসিক ও মেধা বিকাশের চ্যালেঞ্জ। নোট গাইড ব্যাপক প্রসারের জন্য কাজ করে আসছেন বিশাল জনগোষ্ঠী। আমাদের অভিভাবক মহলের বেশিরভাগের ধারণা.. বেশি বেশি বই, বড় বড় পাস নিজের সন্তানদের নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে। অথচ বুয়েট, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির চিত্র দেখলে তারা হতাশ হন, বড় বড় পাসকে নিয়ে। অভিভাবকদের মুখে শোনা যায়, শিশুকালে আমার সন্তান অনেক বড় পাস দিয়েছে, এখন সব হারিয়ে গেছে। হয়তো কেউ বলবেন, সব গুলিয়ে গেছে বা সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে।
বাস্তবে সে পাস যে, জ্ঞান অর্জনমুখী নয়, বিষয়টি অনেকের উপলব্ধিবোধের মধ্যে নেই ।
আমাদের অভিভাবকেরা শিশুদের খাওয়া নিয়েও অনেক বিরক্ত করে থাকেন। জোর করে মারধর করে খাওয়ানোর প্রবণতা আমাদের বেশির ভাগ পরিবারের মাঝে দৃশ্যমান। আমরা গভীরভাবে অনুভব করিনা, শিশুদের খাবারের থলি ও মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা কতোটুকু!
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেলে, বদহজমসহ পেটের পীড়ার আক্রান্ত হয়ে, রক্তশূন্যতাসহ নানা রোগব্যাধি শিশুর স্বাস্থ্যহানি হয়ে থাকে। তেমনি শিশুর বয়স, রুচি সামর্থের বাইরে লেখাপড়া বা বইয়ের চাপ সৃষ্টি করলে শারীরিক, মানসিক ও মেধাবিকাশের পরিবর্তে মেধা ক্ষীণ হয়ে থাকে। আমাদের বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষকদের স্বল্প যোগ্যতা..তাদের প্রশিক্ষন নেই। বিধায় তারা নিজেরা ও শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে নোট-গাইড ব্যবহার করে থাকেন। অনেক বিদ্যালয়ে নোট গাইডের বিক্রির কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন।
অপরদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকটে শিক্ষার্থীর সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অধিকাংশ শিশু দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পরীক্ষা পাসের জন্য তারাও নোট গাইডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
বিভিন্ন পরীক্ষায় নামে প্রতিযোগিতার ফলে নোট গাইডের ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এমনভাবে বইয়ের অনুশীলনী প্রশ্নপত্র সংযোজন করেছেন, যা পাঠ্যপুস্তকের মূল বিষয়বস্তুতে নেই। মন্ত্রনালয় ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে স্বল্পসময়ে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ও বিদ্যালয়ে বৃত্তি গাইডের হিড়িক পড়েছে। মনে হয়েছে..সংশ্লিষ্টরা বৃত্তি গাইড প্রকাশকদের দাওয়াত দিয়ে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার নির্দেশনা জারি করেছেন। শিশু শিক্ষাকে মেধা বিনাশ করার কী অভূতপূর্ব প্রেমের বন্ধন।
মাননীয সচিব সর্তক করে বলেছেন, নোট গাইড থেকে বৃত্তি পরীক্ষার প্রশ্ন আসবে না। যেহেতু নোট গাইড পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেহেতু পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আকাশ বা বাতাস থেকে প্রশ্ন আসার সম্ভবনা থাকে না! অধিকাংশ অভিভাবক, কতিপয় শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্টরা, নানাভাবে নোট গাইডের পৃষ্টপোষকতা করে যাচ্ছেন। কতিপয় প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়া বিষয়টির প্রতি নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকম গাইড বই ছাড়াই মেধা বিকাশ ও সৃজনশীলতায় ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে পারদর্শী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আগামী প্রজন্মকে মেধাবী জাতি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য দলমত নির্বিশেষে শিশুদের নোট গাইডের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
লেখক: মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি,বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ, সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা, ডটকম।