দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সরকারি কলেজটি প্রায় ছয় বছর আগে সরকারি হয়েছে। এখনো অধ্যক্ষের পদটি সরকারিভাবে আত্তীকরণ হয়নি। গুঞ্জন রয়েছে, বর্তমান অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল ডিগ্রি কলেজকে উচ্চ মাধ্যমিক দেখিয়ে নিজের পদ বাঁচাতে চেষ্টা করছেন। কৌশলে কলেজের নাম থেকে ‘ডিগ্রি’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রভাব খাটিয়ে বিধি ভেঙে কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ছিলেন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। তিনি বর্তমান অধ্যক্ষের আপন ভাই।
জানা যায়, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর সরাইল ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন গভর্নিংবডির সভাপতি। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। অধ্যক্ষ নিয়োগের তিন দিন আগে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিসহ নানা অসংগতির অভিযোগ এনে জিয়াউল হক মৃধাসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার (সরাইল) সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলাটি করেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আশরাফ উদ্দিন মন্তু ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল উদ্দিন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।
বিধি অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃধা আহমাদুল কামাল ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে কলেজের অধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নেন। কলেজের সাতজন সহকারী অধ্যাপক এবং দুজন সিনিয়র প্রভাষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে জুনিয়র একজন প্রভাষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়।
সরাইলে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইতিহাসবিদ, ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ মো. আবু হামেদ ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৯ একর জায়গা কলেজের নামে দলিল করে দেন তিনি। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন সরাইল কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর ১৯৭৪-এ এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে অধিভুক্ত হয় এবং কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে এই সরাইল ডিগ্রি কলেজেটিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধীনে নিয়ে ডিগ্রি কোড (৩৮১২) দেয়। এ ছাড়া কলেজে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান দুটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। এতে বোঝা যায়, এটি একটি স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ডিগ্রি কলেজকে উচ্চ মাধ্যমিকের এমপিওভুক্ত দেখিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অধ্যক্ষ পদের জন্য পঞ্চম গ্রেডের উপাধ্যক্ষকে অধ্যক্ষ হিসেবে পদ সৃজনের জন্য সুপারিশ করা কতটা যৌক্তিক—এমন প্রশ্নও উঠেছে। বিধি অনুযায়ী ডিগ্রি-অনার্স কলেজের জন্য চতুর্থ গ্রেডের একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার কথা। অথচ সেখানে পঞ্চম গ্রেডের একজন উপাধ্যক্ষকে অধ্যক্ষ বানাতে এ কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে কলেজের একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী মনে করেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট সরাইল ডিগ্রি কলেজটি সরকারীকরণ হয়। সে অনুযায়ী একই বছর শিক্ষক-কর্মচারীদের যাবতীয় তথ্য আত্তীকরণের লক্ষ্যে অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর পদ সৃজনে সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মৃধা আহমাদুল কামালের অধ্যক্ষ হিসেবে অভিজ্ঞতা না থাকায় তার পদটি সৃজনে সুপারিশ করেনি। এ ছাড়া ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের পদসৃজন সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণীতে মৃধা আহমাদুল কামালের ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকার বিষয়টি উঠে আসে। সে সময় জানানো হয়, তার নিয়োগ প্রক্রিয়াটি যথাযথ ছিল না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দেওয়া প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ আবেদন করেন মৃধা আহমাদুল কামাল। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ কলেজ কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে সুপারিশ করা হয়, সরাইল ডিগ্রি কলেজটি ডিগ্রি পর্যায়ে এমপিওভুক্ত নয়। কলেজটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্ত। জনবল কাঠামো ২০১০ (সংশোধনী মার্চ, ২০১৩) অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগে প্রভাষক পর্যায়ের এমপিও হতে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। অধ্যক্ষ উচ্চ মাধ্যমিক কোডে এমপিওভুক্ত এবং পঞ্চম ধাপের পঞ্চম গ্রেডে বেতন পান। তার (মৃধা আহামাদুল কামাল) নিয়োগ-সংক্রান্ত রেজ্যুলেশন ও নিয়োগ নম্বরপত্র পাওয়া গেছে। সেজন্য পদ সৃজন করা যেতে পারে।
কৌশলগত কারণে সরকার কর্তৃক ঘোষিত কলেজের নাম ‘সরাইল ডিগ্রি কলেজ’-এর বদলে সরাইল সরকারি কলেজের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিগ্রি কলেজকে শুধু সরকারি কলেজ সংবলিত সাইনবোর্ডও সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে স্থানীয়দের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
একটি পক্ষ শত্রুতাবশত নানা অভিযোগ তুলছে দাবি করে মৃধা আহমাদুল কামাল বলেন, ‘নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ মিথ্যা। ওইদিন আমার ভাই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন না। তিনি পরে এসে স্বাক্ষর করেছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘ডিগ্রি কলেজকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর দেখানোর কিছু নেই। কলেজটি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজটিতে শুধু ডিগ্রি পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি রয়েছে। যাকে অধিভুক্তি বলা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য ১২ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। সে অনুযায়ীই আমার নিয়োগ হয়েছে। জনপ্রশাসন এবং মাউশিও এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে অধ্যক্ষ নিয়োগের পূর্বানুমতিপত্র এবং অধ্যক্ষ নিয়োগের যোগদান অনুমতিপত্র দেওয়া আছে।’
কলেজের নাম থেকে ডিগ্রি শব্দটি বাদ দেওয়ার বিষয়ে মৃধা আহমাদুল কামাল বলেন, ‘যেহেতু কলেজটি সরকারি হয়েছে। এখানে ডিগ্রি এবং অনার্স চালু আছে। ভবিষ্যতে মাস্টার্স চালু হতে পারে। কোনো একটি বিষয়ের ওপর কলেজের নাম হওয়া কাম্য নয়। তাই কলেজটিকে সরাইল সরকারি কলেজ লেখা হয়।’
অধ্যক্ষ নিয়োগ অবৈধ ছিল না, দাবি করে তৎকালীন সরাইল ডিগ্রি কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা বলেন, ‘আমি কলেজ কমিটির সভাপতি থাকলেও আমার ভাই ওই পদে দরখাস্ত করার পর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ কমিটি থেকে সরে আসি। আমার ভাই তার যোগ্যতার ভিত্তিতেই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। এখানে কোনো প্রভাব কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় না।’
সূত্র: দৈনিক কালবেলা, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪