‘মা’ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ। ‘মা’ শব্দের চেয়ে মধুর ও বিশুদ্ধতম শব্দ পৃথিবীর কোনো সংবিধানে নেই। ‘মা’ শব্দটা খুবই ছোট। কিন্তু এর মাহাত্ম্য ও পরিধি অসীম। মায়া-মমতা-ভালোবাসার খনি যাকে বলা হয় তিনি হলেন মা।
এই পৃথিবীতে মা-ই আমাদের সবচেয়ে কাছের আপনজন। একজন সন্তান জন্মের পর থেকে আমৃত্যু যার ছায়ার পরশে জীবনকে বেঁধে রাখেন তিনি হলেন মা। মায়ের সমার্থক শব্দ গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু ‘মা’ এর চেয়ে মধুর ডাক পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। এমনকি পৃথিবীর মহামনীষীরাও বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের নাম মা।
যতো কষ্টই থাকুক না কেনো, মায়ের কথা মনে হলে নিজের অজান্তেই যেনো ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। যে মানুষটি সকল বিপদে আমাদের পাশে ছায়ার হয়ে থাকেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের সকলের প্রিয় মহীয়সী, গর্ভধারিনী মা। আর তারিখ যাই হোক পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস।
মা দিবসের উদ্দেশ্য হলো-সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, মা ছাড়া এই পৃথিবীতে প্রকৃত আপন বলতে আর কেউ নেই। মায়েদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর জন্যই এই দিবস।
কাব্যিক ভাষায়-‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে’। মাকে কার না মনে পড়ে? যার আছে সেও মনে করে, আবার যার নেই সেও মাকে মনে করে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটাই এমন। ‘মা’ কেবল একটি শব্দে মায়া, মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং ত্যাগের অনন্য নজিরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
পৃথিবীর প্রতিটি সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল মা। মায়ের সারাজীবনের শ্রমের মূল্য কোনো কিছুর বিনিময়ে কখনো শোধ করা যাবে না। মায়ের জন্য বিশেষ দিন থাকার দরকার আছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু একটি বিশেষ দিনে মাকে না হয় একটু বেশিই ভালোবাসা যায়।
কাব্যিক ভাষায় বলা যায়-
‘যেখানেতে দেখি যাহা,
মা-এর মতন আহা।
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!’
মা দিবস উদযাপনের পেছনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, মা দিবসের সূচনা হয় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক স্কুলশিক্ষিকা অ্যানা জারভিস সেখানকার পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দেখে মর্মাহত হয়ে মায়ের জন্য বিশেষ দিন পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির কথা ভেবেছিলেন।
অ্যানা জারভিসের সেই ভাবনা বাস্তবায়নের আগেই ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা এম জারভিস মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশে কাজ শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মা ফিলাডেলফিয়ার যে গির্জায় উপাসনা করতেন, সেখানে সব মাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মা দিবসের সূচনা করেন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।
বিশ্বের ৩৭টিরও বেশি দেশে মা দিবস পালন করা হয়ে থাকে। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বাংলাদেশসহ অস্ট্রেলিয়া, বারবাডোজ, বাহামাস, কানাডা, কলোম্বিয়া, চেক রিপাবলিক, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, সিঙ্গাপুর নিউজিল্যান্ডসহ অন্তত ২৭টি দেশে পালন করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া নরওয়েতে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় রোববার, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, সার্বিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ মা দিবস পালন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মা দিবস পালন করা হয় ২১ মার্চ। এ ছাড়া মে মাসের অন্যান্য দিন, জুন, আগস্ট, অক্টোবর এবং নভেম্বরেরও কয়েকটি দেশে মা দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
মা দিবসে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল৷ সমীক্ষা বলছে, বছরের আর অন্য সব দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তার জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন৷ আচ্ছা সত্যি করে বলতে, মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন পড়ে? তারা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা’ ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান৷
আমার ‘মা’ এখনো বেঁচে আছেন। পৃথিবীতে মা বেঁচে থাকা মানেই ভাগ্যের চাকা সব সময় সচল থাকে। আমি তাই নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবই এ বয়সে মাকে হারিয়েছেন। তাই তাদের শত ইচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের জন্য এই একটা দিন ঘটা করে উদযাপন করার কোনো উপায় নেই।
সেদিন আমার এক বন্ধু বলছে, ‘বন্ধু প্রতিদিনই মায়ের কথা, মায়ের স্মৃতিগুলো মনে পড়’৷ প্রতিদিনই তাই সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটায় বলে বের হয়- ‘কেমন আছো মা?’ বলেই সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। যার মা নেই সেই বুঝে, মা হারানোর বেদনা কেমন!
কিন্তু আমরা আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থার দিকে যদি তাকাই, দেখবো সেখানে আমাদের মায়েরা কতোটা অবহেলিত, নিগৃহীত। আজকাল কতো ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধুকে দেখা যায় মায়েদের অযত্ন করতে, তাদের অবহেলা করতে৷ তখন খুব খারাপ লাগে৷ যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, কথা বলতে শিখিয়েছেন, মুখে তুলে দিয়েছেন অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে৷
আপনি হয়তো বিদেশের সমাজব্যবস্থার কথা টেনে আনবেন। কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা। সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলোতে অনেক বেশি। এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন–এটাই স্বাভাবিক৷ কর্মজীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তারা।
কিন্তু আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা’ বলে ডাকি৷ দেশের মাটিকে মা সম্বোধন করে তার পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা। বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য।
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতোদিন, কতবার মা’কে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি'? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে৷
এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে ওঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু। এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্যই। আমাদের কারো মায়েরই যেনো জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল বিদ্ধাশ্রম না হয়। তাই আসুন মাকে শ্রদ্ধা করি আর অবহেলা, অনাদর থেকে দূরে রাখি। যতদিন ‘মা’ বেঁচে আছেন ততদিন প্রতিটি দিনই ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট