সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আওয়ামী লীগে ঐক্য এনে দিলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল বুঝতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধার পর এবং সহিংসতার ঘটনায় দলের ও সরকারের নানা উদ্যোগ ভেস্তে যেতে থাকায় আওয়ামী লীগের ভেতরে এক ধরনের দুশ্চিন্তাও দেখা দেয়। সর্বশেষ সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে না যাওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না– এমন পরামর্শ দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক মহল। তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল কী হবে, সেটা এখনো দলটি বুঝে উঠতে পারছে না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্রে এসব কথা জানা গেছে। সোমবার (৫ আগস্ট) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পাভেল হায়দার চৌধুরী।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, সরকারি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, শুরুর উদ্যোগ কিছুটা অগোছালো হওয়ায় সামাল দেওয়ার চেষ্টা কাজে আসছে না। তারা মনে করছেন, দলীয়ভাবে মোকাবিলা বা সামাল দেওয়া এখন অনেকখানি অসম্ভবও। এখন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শক্ত হাতে দমন করার নীতি অনুসরণ করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
সূত্র জানায়, সরকার একটি পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সেটি গতকাল রাতেই বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। পরিকল্পনার প্রথমেই রয়েছে গ্রেপ্তার অভিযান। যেহেতু আন্দোলন ছাত্রদের হাত থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তাই বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ত নেতাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সূত্র জানায়, আন্দোলনকারী ও আন্দোলনকারীদের পরামর্শদাতারা কয়েক স্তরে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। পরামর্শদাতা সব স্তরের নেতাদের গতকাল ও আজ সোমবারের মধ্যে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের এক মন্ত্রী বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারফিউর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অনেকটা শিথি লভাবেই চলে আসছিল কারফিউ। গতকাল সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষণা করা কারফিউ সর্বোচ্চ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন লক্ষ¨ একটাই, যেকোনো মূল্যে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া। সরকার সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে। সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী বলেন, ছাত্র আন্দোলনকে সমীহ করে অনেকটা সহজ সমাধানের পথে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দলীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পরিস্থিতি অনুযায়ী যতটা সহনশীল হওয়া যায় সেই চেষ্টায় সামাল দেওয়ার পথে হেঁটেছে। এ সুযোগটাই গ্রহণ করেছে বিএনপি-জামায়াত। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনটা বিএনপি-জামায়াতের হাতে চলে গেছে।
তিনি বলেন, এখন তো ছাত্ররা ধ্বংসযজ্ঞে নেই। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ‘বাহিনী’ যুক্ত হয়ে গেছে। এটা দেশবাসী বুঝতে পেরেছে। সরকারের আরও কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর কত কঠোর হবেন– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারের হাতে কঠোর হওয়ার যেসব সুযোগ রয়েছে, তার ভেতর মাত্র সিকিভাগ হয়েছে।
এদিকে গতকাল ঢাকাসহ সারা দেশে জমায়েত কর্মসূচি ঘোষণা পালিত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণা অনুযায়ী নেতাকর্মীরা মাঠে নামলেও কখনো আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়েছে, আবার ধাওয়া খেয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন সরকার দলের নেতাকর্মীরা। এ প্রতিরোধে কখনো আন্দোলনকারীদের পিছু হটিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, কোথাও আবার নিজেদের পিছু হটতে হয়েছে। দিনভর ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুরসহ গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে।
এতে ঢাকায়ই বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অনেকেই। বেলা ১১টায় থেকে নগরীর বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ডে জমায়েত হতে থাকেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় ধানমণ্ডির ৩/এ সড়কে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় কয়েকশ নেতাকর্মী অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মধ্যে শাহবাগ-সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আন্দোলনকারীদের দখলে– সেটা নিয়ে কানাঘুষা চলে। এ সময় কয়েকজনকে বলতে শোনা যায় মিছিল নিয়ে শাহবাগে যাবেন। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ চান অনেকেই। শেষ পর্যন্ত শাহবাগ না গেলেও সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের আশপাশ নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন সেখানে থাকা নেতাকর্মীরা।
আন্দোলনকারীরা কয়েক দফায় মিছিল নিয়ে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসার প্রস্তুতি নিলে আওয়ামী লীগের জমায়েত হওয়া নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ে ঢাকা দড়্গিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জমায়েত হন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সেখানে কয়েকশ নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকেন। আন্দোলনকারীরা যেমন বাঁশ-কাঠের লাঠি ও লোহার রড নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল-মিটিংয়ে লোহার রড, বাঁশের ও কাঠের লাঠি বহন করেন। তবে অন্যান্য দিনের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কম দেখা গেছে।
শাহবাগ থেকে বাংলা মোটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট পর্যন্ত আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হলেও পুলিশি উপস্থিতি কম দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দুপুর ১২টার দিকে ধানমণ্ডির কার্যালয় থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বের হতে থাকেন। সড়কে থাকা নেতাকর্মীদের মিছিলে যোগ দিতে বলা হয়। দলটির নেতা আহমদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। পরে মিছিল নিয়ে তারা সীমান্ত স্কয়ার পর্যন্ত যান। এরপর আবার জিগাতলা হয়ে ধানমণ্ডির কার্যালয়ের সামনে ফিরে আসেন। এ সময় অতিউৎসাহী কিছু নেতাকর্মীকে রিকশায় থাকা যাত্রীদের মোবাইল চেক করতে দেখা যায়। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের নিবৃত্ত করেন। এরপর নেতাকর্মীদের কিছু অংশ মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে ধানমণ্ডির স্টার কাবাবের সামনে গেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধাওয়াপাল্টা-ধাওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জিগাতলায় ফিরে আসেন। দুপুর আড়াইটার পর আবার খবর আসে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে জিগাতলার দিকে আসছে। এমন সংবাদ শোনার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে আবার সীমান্ত স্কয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন আন্দোলনকারীরা সীমান্ত স্কয়ারের দিকে চলে আসে। এতে পিছু হটেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
সাড়ে ৩টার পর আবারও ধানমণ্ডিতে আসতে চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। সে সময় ককটেল, গুলির আওয়াজ শোনা যায়। তবে কারা গুলি করেছে তা জানা যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধে তখন আবার পিছু হটে আন্দোলনকারীরা। সাড়ে ৩টার পর ধানমণ্ডিতে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। বিকেল ৪টার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে খবর আসে– হাজারীবাগ থেকে একটি দল ধানমণ্ডির দিকে আসছে। তখন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে জিগাতলা পোস্ট অফিস সড়কের দিকে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। ককটেল-গুলির শব্দ শোনা যায়। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
বিকেল সাড়ে ৪টার পর আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। এর আগে কার্যালয় ত্যাগ করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সংবাদ সম্মেলনের আগমুহূর্তে বের হয়ে যান দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সংবাদ সম্মেলনে ১০ মিনিটের মতো কথা বলেন নানক। তবে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি তিনি। সকাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মাহাবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, এসএম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, ফরিদুন্নাহার লাইলী, আমিনুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন, বিপ্লব বড়ুয়া, আবদুস সবুর, সায়েম খানসহ নেতারা।