পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে নির্মাণ করা হয়েছে ১০০ আসনের ছাত্রীনিবাস। বসানো হয়েছে খাট, টেবিলসহ নানা আসবাব। প্রস্তুত ডাইনিংও। কিন্তু সব ঠিকঠাক থাকলেও জনবল না থাকায় এটি চালু করা যাচ্ছে না। ফলে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হচ্ছে। কেউ কেউ বাড়তি টাকা খরচ করে থাকছে মেসে।
কলেজ সূত্র জানায়, এই ছাত্রীনিবাস চালু করতে জনবল প্রয়োজন মাত্র ছয়জন। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে কয়েকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসককে অনুলিপি দেওয়া হয়েছে এবং মৌখিকভাবে একাধিকবার বলা হয়েছে। এরপরও বিষয়টি সুরাহা হয়নি।
কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ। খাগড়াছড়ি পৌর এলাকায় ৯ একর জায়গাজুড়ে কলেজের অবস্থান। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার। এর মধ্যে ছাত্রী ৩ হাজারের মতো। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান হয়।
জানা গেছে, জেলার ৯ উপজেলার পাশাপাশি রাঙামাটির লংগদু, নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকা থেকেও শিক্ষার্থীরা এ কলেজে পড়াশোনা করতে আসেন। ছাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ১০০ আসনের এই ছাত্রীনিবাসটি তৈরি করা হয়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে এই ভবন নির্মাণে খরচ হয় ৫ কোটি টাকা। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে নির্মাণকাজ শেষে এটি কলেজ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচতলার এই ছাত্রীনিবাসে এইচএসসি প্রথম বর্ষ থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রীরা থাকতে পারবেন।
জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ মিছাবাহুদ্দীন আহমেদ বলেন, জনবল-সংকটের কারণে ছাত্রীনিবাসটি চালু করা যাচ্ছে না। এটি পরিচালনার জন্য যে লোকবল প্রয়োজন, তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কলেজে কর্মচারীর পদ আছে ১২টি। এর মধ্যে কর্তব্যরত আছেন মাত্র ৩ জন। কলেজের নিজস্ব কোনো তহবিলও নেই, যা দিয়ে জনবল নিয়োগ করে ছাত্রীনিবাসটি চালু করা যাবে। এ বিষয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হলেও কাজ হয়নি।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রীনিবাসের কক্ষের ভেতর খাট পাতা। ডাইনিংও পুরোপুরি প্রস্তুত। রাখা হয়েছে টেবিল, চেয়ার। এসবের ওপর ধুলার আস্তরণ পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে কোনো কোনো খাট, টেবিল।
কথা হয় কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অংক্রায়ো মারমার সঙ্গে। তার বাড়ি পানছড়ি উপজেলার কুয়াদিয়াছড়া এলাকায়, কলেজ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। বাবা কৃষক, মা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক।
অংক্রায়ো মারমা বলে, বাড়ি থেকে আসতে গেলে ঠিক সময়ে গাড়ি পাওয়া যায় না। কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ গাড়িতে চড়ে তাকে কলেজে আসতে হতো। এ কারণে খাগড়াছড়ি শহরে একটি মেসে থাকে সে। মেস থাকতে মাসে তার এখন খরচ হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ছাত্রীনিবাস চালু থাকলে তা আড়াই হাজার টাকার মধ্যেই হয়ে যেত।
কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেশমি চাকমার বাড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি এলাকায়। তিনি প্রতিদিন তিনটি গাড়ি বদল করে কলেজে আসেন। রেশমি চাকমা জানান, যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন সকাল ছয়টায় রওনা দেন বাড়ি থেকে। দুই কিলোমিটার পথ মোটরসাইকেলে অথবা হেঁটে আসেন তবলছড়ি বাজারে। এরপর ১৪ কিলোমিটার পথ ৮০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে পানছড়ি। পানছড়ি থেকে মাহিন্দ্রাযোগে ৬০ টাকা দিয়ে কলেজে। ক্লাস থাকলে তাঁর কলেজে আসা-যাওয়ায় খরচ হয় ২৮০ টাকা। তার ওপর ভোগান্তি তো রয়েছেই। রেশমি বলেন, ক্লাস করে আসার পর ক্লান্তিতে পড়ায় মনও বসে না।
কলেজ ঘুরে দেখা গেছে, একটি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, একটি তিনতলা একাডেমিক ভবন, কম্পিউটার ল্যাবরেটরি, একটি বিজ্ঞান ভবন ও একটি গ্রন্থাগার রয়েছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকের পদ আছে ৪৬টি। কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ২০ জন। অর্ধেকের বেশি পদই খালি। শিক্ষকসংকটে শ্রেণিকার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আর কোনো ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাস নেই।
ছাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে দ্রুত এই ছাত্রীনিবাস খুলে দেওয়ার দাবি জানান কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ বোধিসত্ত্ব দেওয়ান। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি জেলায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য একমাত্র সরকারি কলেজ এটি। নানা এলাকার শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন। মাইলের পর মাইল হেঁটে ছাত্রীরা আসেন। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, এমন শিক্ষার্থীরাও মেসে থাকেন। তাই শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এই ছাত্রীনিবাস দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।