পাঠ্যবই ও পরীক্ষা সংস্কারে উদ্যোগ প্রশংসনীয় - দৈনিকশিক্ষা

পাঠ্যবই ও পরীক্ষা সংস্কারে উদ্যোগ প্রশংসনীয়

মাছুম বিল্লাহ |

পূর্ববতী সরকারের তথাকথিত নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তুলে দেয়া হয়েছিল। এর পেছনে শক্ত কোনো যুক্তি ছিলো না। যে শিক্ষার্থী গণিত বুঝেনা তাকেও গণিত ও বিজ্ঞান পড়তে হবে। যে শিক্ষার্থীর গণিত, বিজ্ঞানে আগ্রহ বেশি তাকেও সাধারণ বিজ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানে যাদের আগ্রহ নেই তাদের জন্য দায়সারা গোছের যে বিজ্ঞান সিলেবাস সেই বিজ্ঞান পড়েই সন্তষ্ট থাকতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যে পড়ার যাদের কোনোই আগ্রহ নেই সবাইকে সেই বিষয় পড়তে হবে অর্থাৎ জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে। এটি কোন সুচিন্তিত মতামত নয়। 

তৎকালীন মেম্বার কারিকুলামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা যদি বিজ্ঞানের বিষয় আরও বিষদভাবে জানতে চান তাদের সেটি করতে দেয়া উচিত কি না? উনি উত্তরে বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আমাদের দেশকে সার্ভ করেন না, তারা আমেরিকাকে সার্ভ করেন। 

আসালে তাদের কাছে আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে ছিলো না। তারা দু চারজন যা ভাবতেন তাই করতেন। যাদের জন্য বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ বা যাদের ছেলেমেয়ে এইসব বিভাগে পড়বেন তাদের সাথে কথা না বলে এনসিটিবির কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, সবাইকে সব বিষয় পড়তেই হবে। যার সাহিত্য ও ইতিহাস ভাল লাগে, কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহ কম কিংবা বুঝেন না  তাদেরও বিজ্ঞান পড়তে হবে। তারা সবাইকে সব বিষয় পড়িয়ে পূর্ণজ্ঞানদান করার কথা বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, বিজ্ঞানে পড়েও অনেকে নিজ আগ্রহে সাহিত্য পড়েন কিন্তু জোর করে পড়ানো যায়না। এটি আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, অনেক মেডিক্যালের শিক্ষার্থী, বুয়েটের শিক্ষার্থী নিজ আগ্রহে সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলেছেন। এটি সবাই করবেন না। কিন্তু যাদের আগ্রহ আছে তারা করবেনই। তাই বলে জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে বলার মানে হলো কুইনিন খাওয়ানো। দ্বিতীয়ত, উচচ মাধ্যমিকে গিয়ে হঠাৎ করে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিকে বিশাল সিলেবাস অনুসরণ করতে পারা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য মানানসই হয় না। কারণ উচচ মাধ্যমিকে সময় কম, বিষয় ও বিষয়ের কন্টেন্ট অনেক বেশি। ফলে, অনেকেই তা ডাইজেস্ট করতে পারেন না। তাই ফল খারাপ করেন। এসব কোনো চিন্তাই তাদের টাচ করেননি। 

কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মাধ্যমিকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনতে যাচেছ। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারেন। অর্থাৎ এখন যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন তারা বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাননি, তারা দশম শ্রেণিতে উঠে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাবেন যেটি সংক্ষিপ্ত হবে। এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের দুশ্চিন্তাকে অনেকটাই লাঘব করবে। 

আরও বলা হয়েছে, শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, মূল্যায়ণ বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা হবে, যা ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এটিও চমৎকার প্রস্তাব। কারণ পূর্ববর্তী কারিকুলাম পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সময় মুখচেনা কিছু শিক্ষাবিদ যাদের মাঠের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বর্তমান শ্রেণিকক্ষ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের নিয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আর বেশি সময়ই শিক্ষা প্রশাসকদের নিয়ে মিটিং করা হতো, যাদের বই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। কারণ এখানে অর্থের ব্যাপার আছে। আমরা আর একটি কথা ভুলে যাই যে, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট বেশি হচেছ শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষকরা। কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির সাথে লেগে থাকেন। বলা যায়, ৩০-৪০ বছর কিংবা সারাজীবন। শিক্ষা স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্বে থাকা শিক্ষা প্রশাসকদের সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। যারা এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘুরতেই থাকেন। তাই শিক্ষার সাথে তাদের সম্পর্ক কম। অথচ পূর্ববর্তী কারিকুলামের কাজের সময় তারাই মিটিং, ওয়ার্কশপে থাকতেন। আবার মাউশি অধিদপ্তর ও এনসিটিবিতে যেসব শিক্ষক ডেপুটেশনে বা বদলি হয়ে আসেন তারাও কিন্তু বই, কারিকুলাম, শ্রেণিকক্ষ এগুলোর কথা ভুলে যান। তারা শিক্ষকের চেয়ে কর্মকর্তা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচছন্দ্য বোধ করেন। এই শ্রেণিকেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এগুলো সবই কিন্তু ভুল ও আংশিক সিদ্ধান্ত। তাই, বর্তমান সরকার যা বলেছে তা যুক্তিযুক্ত। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ও নতুন পুস্তক মুদ্রণ এবং চলমান মূল্যায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত জরুরি নির্দেশনা বিষয়ক পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ এর বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানাবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় মর্মে প্রতীয়মান।’ 

নির্দেশনায় আরো বলা হয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চলমান পাঠ্যপুস্তকগুলো ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দব্যাপী বহাল থাকবে। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে যথাসম্ভব সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অবশিষ্ট সময়েও বার্ষিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংশোধিত ও পরিমার্জিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ণ করা হবে এবং তার একটি রূপরেখা শিগগিরই বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। ছয়মাস পর পর একটি করে লিখিত পরীক্ষা হবে এবং প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। রূপরেখাটি বিদ্যালয়ে পাঠানোর সাথে সমস্ত মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচার করতে হবে যাতে সবাই বিষয়টি ভালভাবে জানতে ও বুঝতে পারেন। শ্রেণি কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির প্রতিটির ৬টি করে বিষয়ভিত্তিক যে মূল্যায়ন কার্যক্রম অসম্পন্ন রয়েছে সেগুলো আর অনুষ্ঠিত হবেনা। এই সিদ্ধান্তটি দিতে মন্ত্রণালয়ের একটু বিলম্বই হয়েছে কারণ বিদ্যালয় খোলার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন এবং আমরা বিষয়টির সিদ্ধান্ত দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবেন, তাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ এর আলোকে প্রণীত শাখা ও গুচ্ছভিত্তিক সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকগুলো (বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করছেন) প্রদান করা হবে। এই শিক্ষার্থীরা নবম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে দুই শিক্ষাবর্ষে সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি শেষে ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। নতুন কারিকুলামে ছিলো, শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, সেটিও পরিবর্তন হলো। 

নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়---প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে ইতোমধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোর পাণ্ডুলিপি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে মুদ্রণ করা হবে। নতুন কারিকুলাম যে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, যেজন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই। শিক্ষার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এতো সহজে অনুধাবন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। 


লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

একাদশ-দ্বাদশ বাংলা-ইংরেজির সিলেবাস প্রকাশ - dainik shiksha একাদশ-দ্বাদশ বাংলা-ইংরেজির সিলেবাস প্রকাশ ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঠুঁটো জগন্নাথ অধ্যাপকের পকেটে ৬০ লাখ টাকা - dainik shiksha ঠুঁটো জগন্নাথ অধ্যাপকের পকেটে ৬০ লাখ টাকা সব কয়টারে গু*লি কইরা মা*রমু - dainik shiksha সব কয়টারে গু*লি কইরা মা*রমু স্কুলে ভর্তি: সরকারিতে জোয়ার, বেসরকারিতে ভাটা - dainik shiksha স্কুলে ভর্তি: সরকারিতে জোয়ার, বেসরকারিতে ভাটা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবি যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা - dainik shiksha স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবি যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038399696350098