ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে দুটো পাঠ্যবই তুলে নেয়া, সংশোধনীর নামে আরো তিনটি বই আটকে রাখা, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষকদের বুঝার ঘাটতি, বছরের প্রথম দেড় মাসেও সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে না দিতে পারাসহ ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ের কারণে ভীষণ বিপাকে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। গুরুতর এসব জটিলতা থেকে আপাতত রেহাইও মিলছে না। সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের চূড়ান্ত অদক্ষতায় এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান বই পড়া বাদ রেখেই বছর শেষ করার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এমন ক্ষতি পোষাতে সংশ্লিষ্টদের ভাবনাচিন্তাও কম বলে জানা গেছে। শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য দুই শ্রেণিতে ১০টি করে পাঠ্যবই রয়েছে। এই পাঠ্যবইতে যে ‘কনটেন্ট’ রাখা হয়েছে সেটি নিয়ে বই ছাপার আগেই বিতর্ক ছিল। গত ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বইগুলো যাওয়ার পর বিভিন্ন মহলে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এমনকী জাতীয় সংসদ ভবনেও সরকার দলীয় সংসদ সদস্য বই নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেন। এরপর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংবাদ সম্মেলন করে নতুন শিক্ষাক্রমের বই নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি রিপোর্ট দেয়ার আগেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসসিটিবি) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের ‘অনুসন্ধানী বই’ প্রত্যাহার করে নেয়। পাশাপাশি এই দুই শ্রেণির অনুশীলন বই তুলে না নিলেও সংশোধন করে দেয়ার কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়েরও সংশোধনীর কথা জানায় এনসিটিবি। এসব বই তুলে নিয়ে শিক্ষার্থীরা এর বিকল্প হিসেবে কোন বিষয় পড়বে তা জানায়নি এনসিটিবি। আবার নতুন শিক্ষাক্রমে যে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সেটিও বুঝতে পারছেন না শিক্ষকরা। সব মিলিয়ে পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এনসিটিবি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী করবে তার রূপরেখা এখনো প্রকাশ করেনি। তাদের মতে, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে অভিজ্ঞ লোকদের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু এবার নতুন শিক্ষাক্রম করতে গিয়ে এনজিও এবং এনজিও মনোনীত লোকদের সহায়তা নেয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের বাস্তবতা না বোঝেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে গত ৫০ বছর ধরে সাধারণ শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার পৃথক পাঠ্যবই থাকলেও এবার তা এক করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একেবারে শেষ সময়ে এসে বিষয়গুলো আমলে নিলেও তখন আর পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। তবু তিনি পাঠ্যবই থেকে কিছু বিষয় বাদ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এনসিটিবিতে কর্মরত অতিউৎসাহী কর্মকর্তা মন্ত্রীর কথা আমলেই নেননি, যা শিক্ষামন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেন। এরফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে অতিউৎসাহিদের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি কমিটি কাজ শুরু করেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ‘অনুসন্ধানী পাঠ এবং অনুশীলন পাঠ’ নামে দুটি বই রয়েছে। এর মধ্যে এই দুই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ নামে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর ‘অনুশীলন পাঠ’ সংশোধনের কথা জানিয়েছে এনসিটিবি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই দুই বিষয়ের বিপরীতে শিক্ষার্থীরা কী পড়বে সে বিষয়ে এনসিটিবি থেকে কোনো ধারণা দেয়া হয়নি। পাশাপাশি ষষ্ঠ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ের বই সংশোধনের কথা বলেছে এনসিটিবি। সব মিলিয়ে এই দুই শ্রেণির অন্যতম মূল বিষয় ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান বই তুলে নেয়া এবং সংশোধনের কথা বলায় আপাতত এই ৫টি বইয়ের পড়াশোনা বন্ধ। এরকম লেজেগোবরে অবস্থার মধ্যেই এনসিটিবি বলছে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই দেয়া হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তমের ৫টি বই নিয়ে যেখানে নাকানিচুবানি খাচ্ছে সেখানে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই আগামী বছর ৮ম ও নবমে নতুন শিক্ষাক্রমের বই শিক্ষার্থীদের হাতে দিলে ‘তালগোল’ আরো জটিল আকার ধারণ করবে। এনসিটিবি বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, তারা নিজে থেকে এই সংকট উত্তরণ নিয়ে কোনো কিছু ভাববে না। উপরমহল থেকে যা বলা হবে তাই তারা করবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম ) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান গতকাল বলেন, দুই শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার হলেও অনুশীলন বই রয়েছে, সেটি শিক্ষার্থীরা পড়বে। কিন্তু অনুশীলন বই সংশোধন হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংশোধনী এখনই যাবে না। কমিটির রিপোর্টসহ সংশোধনী স্কুলে পাঠানো হবে। কাজেই পড়াশোনার কোনো ঘাটতি হবে না। নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, আপাতত এমন সম্ভাবনা নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় থেকেই সমন্বয়হীনতার মধ্যে ছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। গত অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অবসরে গেলে নতুন চেয়ারম্যান হওয়ার দৌঁড়ে এনসিটিবির দুজন পদস্থ কর্মকর্তা জড়িয়ে পড়েন। এর একদিকে বর্তমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম এবং অন্যজন অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের দায়িত্ব বর্তায় অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের ওপর। সেই থেকে তাদের মধ্যে তীব্র সমন্বয়হীনতা শুরু হয়। সমন্বয়হীনতার প্রভাব পড়ে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর। এই শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যেমন বিপাকে পড়েন; তেমনি বিব্রত হয়েছে সরকারও। পরিস্থিতির চাপে ভোটের কয়েক মাস আগে বিষয়টি নিয়ে যাতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে না ওঠে- সেজন্য সরকার বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু যারা এটা করিয়েছেন তারা এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন এনসিটিবিতে। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে দশায় পড়েছে এনসিটিবি। বছরের প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে সব বিষয়ের সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে না পারার ব্যর্থতা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভুলেভরা পাঠ্যবই নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা।
পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক, কী করলে পরিস্থিতির উত্তরন হবে তাও নির্ধারণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরের বইয়ে খণ্ডিত ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি, মুসলিম ইতিহাস বাদ দেয়া, ধর্মবিরোধী, প্রজনন স্বাস্থ্য ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় পাঠ্য রাখা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এছাড়া সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেয়া এবং অনলাইন থেকে পাঠ নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব করে স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিনামূল্যের পাঠ্যবই। কাগজ সংকটে এ বছর যথাসময়ে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, তা সত্যি হয় যথাসময়ে। জানুয়ারির ১ তারিখ বই উৎসবের দিন সরকার ঘোষণাও করে, এক মাসের মধ্যে শতভাগ বই পৌঁছবে শিক্ষার্থীদের হাতে। কিন্তু দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এ ঘোষণার বাস্তবায়ন নেই। সারাদেশে তো বটেই, খোদ রাজধানীর বড় স্কুলগুলোয় পর্যন্ত নতুন শিক্ষাবর্ষের সব শ্রেণির পুরোসেট পাঠ্যবই পৌঁছায়নি। পাঠ্যবই সংকট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে অনলাইন পিডিএফ বই দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যহত রাখতে। তবে এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তারা বলছেন, শিক্ষকরা পিডিএফ বই দিয়ে ক্লাসে পাঠদান করলেও শিক্ষার্থীরা বাসায় বই ছাড়া অনুশীলন করবে কীভাবে?
বইয়ের সংকটের সমাধান না হতেই ১০ ফেব্রুয়ারি আলোচনা-সমালোচনার পর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিকবিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে এনসিটিবি। বই দুটির কিছু অধ্যায় ব্যতীত অন্য সব অধ্যায়ের পাঠদান অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের। জানা গেছে, আরো কয়েকটি পাঠ্যবইয়ে শিগগিরই সংশোধনী আনা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে শিগগিরই সংশোধনের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, অনুশীলনী পাঠ পরিমার্জন করে পুনরায় দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে কনটেন্ট অল্প হলে সংশোধনী পাঠানো হবে মাঠপর্যায়ে, আর বেশি হলে বর্ধিত অংশ হিসেবে ফের ছাপানো হবে। তিনি বলেন, দুটি বই প্রত্যাহার ও নতুন করে কয়েকটিতে সংশোধনের সিদ্ধান্ত সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আমরা এখন যেসব বই সংশোধন হবে, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি। তাদের মতামত অনুযায়ী সংশোধনী ছোট হলে আমরা তা সংশোধনী আকারে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেব। আর বেশি এলে পুরো বই পাল্টে দেয়া হবে। আশা করছি দ্রুতই সংশোধন করা সম্ভব হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালকের নেতৃত্বে যে কমিটি সরকার গঠন করা হয়েছে, তারা পরিমার্জনের কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে এখনো যে বিভিন্ন শ্রেণির সব বই সরবরাহ হয়নি তার চিত্র মিলেছে। আর বই না যাওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ঠিকমতো শুরু হয়নি। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের বড় স্কুলগুলোতে এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ ভার্সন ডাউনলোড করে পড়াশোনা চলছে আগে থেকেই। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই এখনো পাননি।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, পাঠ্যপুস্তক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একে আমরা ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি না। তিনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে ত্রæটি-বিচ্যুতি প্রতি বছরই থাকে, এবারো ছিল। প্রকাশনা শিল্প ঠিকঠাকভাবে না দাঁড়ানো এবং এনসিটিবিতে সমন্বয়হীনতাসহ আরো কিছু কারণে এই ভুলগুলো থেকেই যাচ্ছে।