দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম- ২০২১ বাতিল করে যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও দ্বীনদার শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করাসহ এক গুচ্ছ দাবি জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম।
শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘নতুন পাঠ্যপুস্তকে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ দাবি জানান।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মো: নাছির উদ্দিন খান উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে আরো যেসব দাবি জানানো হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- পাঠ্যপুস্তক থেকে বিতর্কিত ও ইসলামী আকিদা বিরোধী প্রবন্ধগুলো বাদ দেয়া। স্কুল ও মাদরাসার সব পাঠ্যপুস্তক বিজাতীয় সংস্কৃতি, অনৈসলামিক শব্দ ও অশ্লীল চিত্রমুক্ত রাখা। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো ও শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা। প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাতিল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডার কোটা বাতিল করা। সমাজে অবহেলিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দুস্পষ্ট নীতিমাল প্রণয়ন করা। ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এবং পাঠা-পুস্তকের নামকরণ নিজ ধর্মের নাম অনুসারে করা। নৈতিকতা সমৃদ্ধ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে সব ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। শিক্ষার সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রের বহন করা এবং ইবতেদায়ী মাদরাসাসহ সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা। পুরুষ ও মহিলা উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক বেকারত্ব ও খাদ্য ঘাটতির সমাধান এবং অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কৃষি শিক্ষা ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান শিক্ষা সকল শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্ম ও নৈতিকতাকে সরিয়ে ফেলে, মৌলিক দর্শন হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ও সেক্যুলারিজমকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ ধর্ম শিক্ষাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এ তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সুকৌশলে ধর্ম তথা ইসলাম শিক্ষাকে প্রকারান্তরে বাদ দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে করা হয়েছে সংকুচিত।
এই কারিকুলামে লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও বাংলার কৃষকের সন্তানেরা। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগণের সন্তান শ্রমিক, কেরানি ও আমলাদের সেবাদাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না।
নতুন কারিকুলামে খুব সুক্ষ্মভাবে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী যে সকল বিষয় রয়েছে সেগুলোর অন্যতম হলো- শিল্প ও সংস্কৃতির নামে ইসলামি সংস্কৃতি মুছে ফেলা, একমুখী শিক্ষার নামে মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, বিজ্ঞান শিক্ষা সংকোচনের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের মেধাকে ধ্বংস করে জাতিকে পরনির্ভরশীল করার পাঁয়তারা, শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পরিচয় যাতে না থাকে এভাবে তাদের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করা, মানব সভ্যতা বিধ্বংসী ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ ও যৌনাচারকে প্রমোট করা, পৌত্তলিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আধিপত্য, অর্থাৎ ডি-ইসলামাইজেশনের পাঁয়তারা ইত্যাদি।
এছাড়া মুসলিমদের অবদান গোপনের চেষ্টাও করা হয়েছে। যেমন- ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উল্লেখ করার মাধ্যমে মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মত্যাগের ইতিহাসকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে যা মূলত: ইতিহাস বিকৃতি ও মুসলিমদের অবদান গোপনের মারাত্মক অপচেষ্টা। এছাড়াও মুসলিম শাসকদের ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অত্যাচারী শাসক হিসাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। কৃষিশিক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। আগে গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে মেয়েদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সফল হওয়ায় কৌশল শেখানো হতো। কিন্তু এই শিক্ষাকে বাদ দিয়ে আমাদের কোমলমতি মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে ড্যান্সার, নায়িকা, গায়িকা, অভিনেত্রী ইত্যাদি বানানোর প্রচেষ্টা মূলতঃ পারিবারিক বন্ধনকে অশান্তির দিকে ধাবিত করবে।
নতুন বইকে পশ্চিমা মতবাদের বয়ান আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে যা ইতোপূর্বে ছিলো না। যেমন- ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণির ইংলিশ ফর টু ডে বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরস্পর কথোপকথনের সময় সালাম বিনিময় ছিলো। কিন্তু সালাম মুছে ফেলে যেখানে 'গুড মনিং' শব্দ দেয়া হয়েছে। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণির 'বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়" বই এর ৩৯ পৃষ্ঠায় দেশীয় সংস্কৃতির নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ঢোল-তবলা উপস্থাপন করা হয়েছে। ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই এর ১৮, ৯৫ ও ৯৬ পৃষ্ঠায়, চতুর্থ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বই এর ৮৪ পৃষ্ঠাসহ অনেক ক্ষেত্রেই ডি ইসলামাইজেশন করা হয়েছে।
৬ষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে , আমার মা কপালে চুমু দিলেও, আমি হয়ত আমার বন্ধুকে চুমু দিতে দিব না। তবে সে একই বন্ধুর সাথে হাত ধরে ঘুরতে হয়তো আমার অস্বস্তি লাগবে না।- এখানে মেয়ে নাকি ছেলে বন্ধু তা উল্লেখ করা হয়নি। আবার চুমু খেতে হয়ত না দিলেও হাত ধরে ঘুরতে-বের হতে তেমন বাঁধা নেই। আজকে সমাজে অসংখ্য কিশোর কিশোরী পিতা-মাতার অজান্তে বন্ধুর হাত ধরে নিখোঁজ হচ্ছে এবং ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের সভ্য সমাজকে পশ্চিমাদের মত অসভ্য অবাধ যৌনতার সমাজে পরিণত করার কুটকৌশল বৈ কিছুই নয়।
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরিফ ও শরিফার গল্প আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত বইয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দেও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে ট্রান্সজেন্ডারকে তালগোল পাকিয়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত সমকামিতা বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই কারিকুলাম একমুখী হওয়ায় জেনারেল সাবজেক্টগুলো হুবহু স্কুল শিক্ষার সিলেবাস থেকে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে সেগুলো মাদরাসা শিক্ষার বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত। ঘষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে নারী পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কী নির্গত হয়, কোন অঙ্গের আকার কেমন হয় এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন আকর্ষণ হয় তা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমনা শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন অনুপযোগী, তেমনি বিষয়টি পাঠদানে শিক্ষকরাও হচ্ছেন চরমভাবে বিব্রত। একই শ্রেণির বিজ্ঞান ও অনুসন্ধানী পাঠ এর ১০ম অধ্যায় ‘মানব শরীর’ শিরোনামে ১১১ থেকে ১১২ পৃষ্ঠায় নারী-পুরুষের গোপনীয় অঙ্গগুলো সম্পর্কে খুব খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যা থেকে কোমলমতি শিশুর মনে ভয়ংকর কুপ্রভাব পড়ছে। পাঠ্য বইয়ের এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ডিসকাশন করতে হয়, গ্রুপ এসাইনমেন্ট করতে হয়। শিক্ষার্থীদের এ বিষয় ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করতে গেলে তারা পর্নোগ্রাফির মুখোমুখি হবেন। এভাবে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে লজ্জার বাঁধন উঠে যাবে এবং যে কোনো অনৈতিক কাজে তাদের অনায়াসে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ভাষার চেয়ে সাহিত্য বেশী। আমরা মনে করি অনার্স-মাষ্টার্স লেভেলের গল্প ও কবিতার পাঠ অষ্টম শ্রেণিতে নিয়ে আসা হয়েছে। এই বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য এই সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করতে পারা ততটা সহজ নয়। ফলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ভীতি সৃষ্টি করবে।
শিক্ষা কারিকুলাম-২০২১ এ সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো- প্রায় প্রতিটি বিষয়ই সবচেয়ে কম মেধাবী ছাত্রের কথা বিবেচনা করে পাঠাপুস্তক প্রণীত হয়েছে যা বিজ্ঞান বইগুলোতে চোখ রাখলেই লক্ষ্য করা যাবে। এতে করে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার বিকাশ করতে পারবে না। ফলে বহির্বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। জাতি হিসেবে আমরা আরো পিছিয়ে পড়বো।