পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ - দৈনিকশিক্ষা

ফারাক্কা লংমার্চ দিবসপানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া |

ফারাক্কা লংমার্চ বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের পানি আগ্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। নদীমাতৃকার দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, সুরমা, তিস্তা, বরাকসহ অসংখ্য ছোটবড় নদ-নদী বাংলাদেশকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৫টির উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে। বাংলাদেশের মিঠা পানির মাত্র ৭ ভাগ পাওয়া যায় এখানকার বৃষ্টির পানি থেকে আর ৯৩ ভাগ আসে সীমান্তের ওপার থেকে বৃষ্টি ও বরফ গলানোর ফলে।

নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ আজ প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশ আজ তার স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পানি নেই। এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা আজ ধু-ধু মরুভূমি। এর কারণই হচ্ছে ফারাক্কা। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা। বাংলাদেশের রাজশাহী সীমান্তে এসে পদ্মা নাম ধারণ করে দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারত গঙ্গার পানি উত্তর প্রদেশ এবং বিহার প্রদেশে সেচ কাজের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে প্রত্যাহার করায় পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী-হুগলি নদীর পানি প্রবাহ কমে আসে। সেজন্য ভারত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা বন্দরের নাব্য বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সীমানার ১০ কিলোমিটার উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে বাঁধ দিয়েছে। এই বাঁধের প্রথম পরিকল্পনা করা হয়েছিলো ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। সে বছর অক্টোবর মাসে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হলে পাকিস্তান সরকার পত্রপত্রিকার রিপোর্টকেই ভিত্তি করে এই বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভারত সরকারের নিকট কঠোর ও তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পরবর্তী ১০ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে এ পর্যায়ে দেনদরবারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। যদিও ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের পর জানা যায় যে, ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। এ পর্যায়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানান। ফলে বাঁধ নির্মাণ ধীরগতিতে চলতে থাকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শেষ করে।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নতুন দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দ্বীপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকেই সর্বপ্রথম বলা হয় যে, কলকাতা বন্দরের চাহিদা ও বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি গঙ্গায় না থাকায় চাহিদা মেটানোর জন্য পানির প্রবাহ বাড়াতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করছে ভারত। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে ফারাক্কা ফিডার ক্যানেলটির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কার বাঁধ চালু করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়। পরীক্ষামূলক সময়টি হবে ১৯৭৫’এর ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে এই ৪১ দিন। বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। তারপর আর সেই ৪১ দিন শেষ হয়নি। মরহুম জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের একটি চুক্তি হয়েছিলো এবং ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনার সরকারের সময় একটি পানি চুক্তি সম্পাদন করেছে।

ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বীপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করলেও সেই সময় মনে হয় আজও অতিবাহিত হয়নি। শুরু হয় বাংলাদেশের দুর্দশা। পানির অভাবে ধীরে ধীরে প্রমত্তা পদ্মা হয়ে ওঠে ধু-ধু বালুচর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ক্রমান্বয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। বাঁধ চালুর আগে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানির প্রবাহ থাকত প্রায় ৭৪ হাজার কিউসেক। বাঁধের পর পদ্মার গড়ে বছরে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ হতো।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর কৃত্রিম খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয়, কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা। এ ছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চার শ’ পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

জাতিসংঘের সাবেক পানি বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খানের মতে, ফারাক্কা বাঁধের আগে গঙ্গা হয়ে পদ্মায় গড়ে বছরে যে ৫২৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হতো, ফারাক্কা বাঁধ ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে এখন বাংলাদেশে আসে মাত্র ২০৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি। বলা যেতে পারে প্রায় ৬০ ভাগেরও বেশি পানি ফারাক্কার মাধ্যমে ভারত সরিয়ে নিচ্ছে। এর কারণে বছরজুড়ে পদ্মা নদী দিয়ে পলি আসে না। আবার বর্ষাকালে যখন পানি একেবারে ছেড়ে দেয় তখন অনেক বেশি পলি পড়ে, সেই পলি সমুদ্র পর্যন্ত যেতে পারে না। এভাবেই পদ্মা ধীরে ধীরে ধু ধু বালুচর এবং বিরানভূমি হয়ে যাচ্ছে, যা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে।

ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন সেই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন সেদিন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার পানির ওপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।’ তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং ‘আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।’

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন বত্তৃতা করছিলেন তখন এক নয়া জাগরণ সৃষ্টি করে। মাঠের আশপাশে তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। প্রতিবাদী জনতার মধ্য থেকে হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে ‘লও লও লও সালাম-মওলানা ভাসানী; সিকিম নয়, ভুটান নয়-এ দেশ মোদের বাংলাদেশ।’ আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এরকম নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

তখনো বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ ফারাক্কার ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে না পেরেই ফারাক্কার পক্ষে ওকালতিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আর সে কারণেই ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

ভারত উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ সরকারগুলো টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে দেশের স্বার্থবিরোধী ওকালতি করছে। যে সরকার ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না, দেশের জনগণের কল্যাণ ও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।

বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার প্রতিবেশী ভারতের পানি আগ্রাসন আজ ষোল কোটি জনগণ অধ্যুষিত বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ শুধু এ দেশের মানুষের জীবন-মরণের সংকটই নয় বরং এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাভাবিক প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিপন্ন হয়েছে। এ দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘ভারত ঠান্ডা মাথায় যে কাজটি করে যাচ্ছে, তা হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর অমানবিক বোমা বর্ষণের চাইতে কম নিষ্ঠুর নয়। তার প্রলয়ঙ্করী প্রতিক্রিয়াগুলো একসঙ্গে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি না বলে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ চোখ বুঁজে এই জুলুম সহ্য করে যাচ্ছি।’ আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে ভারতের পানি আগ্রাসনের পরিণতি যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে, তা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন ভাসানী। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এ মানুষটি ভগ্ন শরীর নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে জাতিকে এক কাতারে সমবেত করতে ডাক দিয়েছিলেন। তার সে ডাকে লাখ লাখ মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে তিনি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, আন্তর্জাতিক যাবতীয় আইন-কনভেনশনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত অপরাধী দেশের স্তরে নেমেছে।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে ফারাক্কা বাঁধের ফলে সৃষ্ট জীবন-মরণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েও আমরা চুপ করে আছি বছরের পর বছরজুড়ে। মানবসৃষ্ট এ চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে পারছি না। জাতীয় জীবনের এ মহা-সংকটকালে গোটা জাতির যেখানে শিরদাঁড়ার ওপরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুধু বিভক্তিই লালন করে যাচ্ছি। আমাদের দুর্বলতা কোথায় তা আজ স্পষ্ট। ৪৮ বছরে ফারাক্কা সমস্যার মতো জাতীয় সংকটও যখন আমাদের জাগাতে পারেনি, নব্যকারবালার সৃষ্টিকেও যখন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছি, তখন আরো বড় বিপর্যয় আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।

আজ সময় এসেছে দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশিদের এক কাতারে দাঁড়িয়ে দেশের স্বার্থের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার। ভারতের অন্যায় আগ্রাসী পানি নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার। মওলানা ভাসানীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি হলঠপল স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: ‘জনগণের সংগ্রাম পারমাণবিক মারণাস্ত্রের চাইতে শক্তিশালী’।

ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে লংমার্চের পূর্বে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দেলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এতো বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।’ যার উত্তরেও মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার ওপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপূরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরুপ প্রত্যাশা ছিলো না।’ এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

পানি বিষয়ে ভারতের সব সরকারই সকল সময় আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো এবং আছে। তাদেরও কোনো আশ্বাসের বাস্তবায়ন বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি দেখতে পায়নি গত ৫৩ বছরেও। ভারতের নিকেট থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হলে প্রয়োজন মওলানা ভাসানীর মতো নেতৃত্ব। মরণবাঁধ ফারাক্কার কারণে আজ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। নতুন করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে সিলেটসহ দেশের আরো বৃহত্তর অংশ মরুভূমিতে পরিণত হবে। ভারতের এই পানি নিয়ে অপরাজনীতি বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে। 

মেয়াদোত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙে ফেলা হবে কি না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যেকোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা। অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশরে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এক কালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায়। পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সঙ্গে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সবধরনের মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।

ভারতে নিকট থেকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় কোনো দলীয় সমস্যা নয়। এই সমস্যা দেশের এবং সমগ্র জাতির। কারণ, এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এই অবস্থায় পানির অধিকার আদায়ে দ্বীপাক্ষিক, আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পানির অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা বুদ্ধিজীবীরা কী ভাবছেন বা বলছেন এটি কোনো বিষয় নয়। জনগণকেই লড়াই চালাতে হবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটিমাত্র সমঝোতা হতে পারে আর তা হচ্ছে কোনো প্রকারেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। এ আন্দোলনে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন ভাসানী। 

ফারাক্কা কিংবা টিপাইমুখ বাঁধের এই সমস্যা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত-বাংলাদেশ ন্যাপ-ইসলামী আন্দোলন-খেলাফত আন্দোলন-খেলাফত মজলিশ-ইসলামী ঐক্যজোট-এলডিপি-মুসলিম লীগ-এবি পার্টি বা অন্যান্য ইসলামি দলগুলো কিংবা গণফোরাম-জাসদ-কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি-কমিউনিস্ট পার্টি বা বামদলগুলোর দলীয় কোনো সমস্যা নয়। এই সমস্যা দেশের এবং সমগ্র জাতির।

আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশ যাতে পানির ন্যায্য হিস্যা পায় সে বিষয়ে জাতীয় সংসদে দল-মত নির্বিশেষে প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত। পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত সরকারকে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার প্রকল্প বন্ধ রাখতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে হবে।

ভারতের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক এবং চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পানি বন্টনের অববাহিকা চুক্তি হয়েছে, সেই আলোকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বেসিন গুলোর দেশগুলোকে নিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বেসিনভিত্তিক আলাদা আঞ্চলিক পানি কমিশন গঠন করে বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ এবং অন্যান্য বাঁধের মাধ্যমে ভারত পানি সরিয়ে নেয়ার প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের যে ১০০ বিলিয়ন টাকা বছরে ক্ষতি হচ্ছে তা ভারত সরকারের কাছে অতি শিগগিরই দাবি করতে হবে।
নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানীর মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ-সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

অন্যদিকে ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের বিষয়ে বিশ্ববাসীকে অবহিত করার জন্য পানি আন্দোলনকে আরো বেগবান ও ফলপ্রসূ করতে হবে। এজন্য দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত প্রত্যেকটি বাংলাদেশির এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং দাবি করতে হবে নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও, বাংলাদেশ বাঁচাও।
লেখক: কলাম লেখক ও মহাসচিব বাংলাদেশ ন্যাপ 

 

 

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029029846191406