ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের পরিবারের সংযোগ ঘটে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে। ওই বছর আমার আপন চাচাতো ভাই আবদুল খালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি শহীদুল্লাহ হল (তখন ঢাকা হল) -এর আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
আমি ভর্তি হই ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে (সেশন ১৯৭৫--৭৬)। সেশনজট নিরসনকল্পে ১৯৭৫ এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াদেরকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে একত্রে ভর্তি করা হয়। তারা একত্রে ভর্তি হলেও ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে পাস করাদেরকে ১৯৭৫--৭৬ এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পাস করাদেরকে ১৯৭৬--৭৭ সেশনে ভর্তি দেখানো হয়। তবে উভয় গ্রুপেরই ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে একসঙ্গে ক্লাস শুরু হয়। একে বলা যায়, হিসেবের খাতায় এক রকম, গোয়ালে আরেক রকম।
আমি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাস করি। তবে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। রেজাল্ট হতে হতে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ চলে আসে। ফলে ১৯৭৫--৭৬ সেশনে ক্লাস শুরু করা সম্ভব ছিলো না। তাই আমাদেরকে কয়েক মাস পিছিয়ে এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পাসকরাদের সেশন ঠিক রেখে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে একই ব্যাচ হিসেবে ক্লাস শুরু হয়। এতে স্কুল-কলেজে আমাদের এক ক্লাস জুনিয়ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের ক্লাসমেট অথবা ইয়ারমেট হয়ে যায়। আমি এসএসসি পাস করি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। যারা ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি করি, তাদের নবম শ্রেণিতে পড়া হয়নি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের নবম শ্রেণিতে পড়ার কথা। কিন্তু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের কারণে ক্লাস হয় নি। স্কুল বন্ধ ছিলো। যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে আমরা নবম শ্রেণির চেহারা না দেখেই, সরাসরি দশম শ্রেণিতে উঠি।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি। আমি এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। হলে সিনিয়ররা আমাদেরকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। আমরা তাদেরকে বড়ো ভাইয়ের মতো মান্য করতাম। হল কর্তৃপক্ষ মেধা এবং প্রয়োজনে লটারির মাধ্যমে সিট বরাদ্দ দিতো। বরাদ্দ প্রক্রিয়া ছিলো উম্মুক্ত ও স্বচ্ছ।
এখন সম্ভবত তেমন অবস্থা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিলাভ
আমি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। একই বছরের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ পদত্যাগ করি। ২৭ অক্টোবর বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করি।
আমরা একেবারে সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একঝাঁক তরুণ প্রভাষক হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে যোগদান করি। একেবারে বিনা তদবিরে, বিনা ঘুষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুর রকিব ও অধ্যাপক আ. ন. সামসুল হক আমাদেরকে চাকরি দিয়েছিলেন। মোসলেম ও আমি ১ মে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করি। সামসুল হক স্যার ওইদিন রাতে আমাদের দুজনকে তাঁর বাংলোতে দাওয়াত দিয়ে ডিনার খাওয়ান। কী সুন্দর স্মৃতি! বিনা পয়সায় চাকরি দিলেন, আবার রবাংলোতে দাওয়াত দিয়ে ডিনারও খাওয়ালেন।
আমাদেরকে চাকরি দেয়াতে স্থানীয়রা কেউ আপত্তি করেন নি। কারণ উপাচার্য মহোদয় এবং সামসুল হক স্যার সততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে আমাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সততা ও স্বচ্ছতার নীতি অবলম্বন করলে কাজ করা সহজ হয়ে যায়।
এখন সম্ভবত এমন অবস্থা নেই। কারণ এখন সততা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে, পদ-পদবি লাভের লোভও বেড়ে গেছে। উল্লেখিত তথ্যগুলো আমাদেরকে নতুন করে চিন্তা করার উৎসাহ জোগাতে পারে!
সিভিল সার্ভিস বিষয়ক
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা ছিলো ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। অনার্স পাস করার কথা ছিলো ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। ভর্তিতে এক বছর বিলম্বের কারণে পাস করার কথা ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেক্ষেত্রে ১৯৮১ ব্যাচের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হতো। ১৯৮১ ব্যাচের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয় ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু সেশন জটের কারণে সে সুযোগ ঘটে নি। সেশনজটের কারণে আমরা অনার্স পাস করি ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে শেষ দিকে। দরখাস্ত আহ্বানের সময় আমাদের অনার্স পরীক্ষাও হয় নি। ফলে অ্যাডমিট কার্ড দিয়ে দরখাস্ত দেয়ার সুযোগও ছিল না।
আমাদের অনার্স পরীক্ষা দেয়ার পরে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছিলো ১৯৮২ ( নিয়মিত) ব্যাচের পরীক্ষা। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শেখ আবদুর রশিদ, মোসলেম উদ্দিন, জিশা নআরা আরাফুন্নেসা ও আমি সে সুযোগ গ্রহণ করি এবং চাকরি পেয়ে যাই ।
১৯৫৭ ব্যাচের সিএসপি খোরশেদ আলম এবং ১৯৬৯ ব্যাচের সিএসপি ড. সা'দত হুসাইন ২০ বছর বয়সে বিএ পাস করেন। সিভিল সার্ভিসে যোগদানের জন্য দরখাস্ত করার ন্যূনতম বয়স ছিলো ২১ বছর। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বয়স ২১ বছর না হওয়ায় খোরশেদ আলম ১৯৫৬ ব্যাচ এবং ড. সা'দত ১৯৬৮ ব্যাচের জন্য দরখাস্ত করতে পারেন নি।
তখন সেশনজট ছিলো না। তাই তাঁরা সময়মতো পাস করেন। কিন্তু সেশনজট থাকায় আমরা সময়মতো পাস করতে পারি নি। ফলে সময়মতো আমরা দরখাস্ত করতে পারিনি। তথাপি প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় চাকরি পাওয়াসহ মোট ০৮ টি প্রথম শ্রেণির/সমমানের চাকরি পেয়েছিলাম।
আইসিএস ও সিএসপি অফিসাররা সরাসরি লাহোর একাডেমিতে যোগদান করতেন, প্রশিক্ষণ শেষ করতেন। অত:পর মাঠ প্রশাসনে কাজে যোগদান করতেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে আগে প্রশিক্ষণ, পরে কাজ নীতিটি বাস্তবায়ন করা হয় নি। ১৯৭৭ ব্যাচকে প্রথমে Staff Training Institute (STI), NIPA Complex, Arts Building Area, Dhaka University -তে পাঠানো হলেও সেটি ছিলো নিয়োগ বিলম্বিত করার কৌশল।
"আগে প্রশিক্ষণ নাও, তৈরি হও, অত:পর কাজে যাও" নীতির প্রথম বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৭৯ ব্যাচ থেকে।
ওই ব্যাচে সব জেনারেল ক্যাডার মিলিয়ে মোট অফিসার ছিলেন অফিসার ছিলেন ১২৯ জন। তন্মধ্যে ৫৭ জনকে সরাসরি শাহবাগস্থ সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি (কোটায়) বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। অন্যদেরকে পদায়ন দিয়ে কাজে পাঠানো হয়। কোটার ধারণ ক্ষমতা কম থাকায় এক গ্রুপকে প্রশিক্ষণে এবং আরেক গ্রুপকে পদায়ন দিয়ে কাজে পাঠানো হয়। লাহোর একাডেমির ধারণ ক্ষমতা বেশি ছিলো, তখন সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিসে অফিসারও কম সংখ্যায় নেয়া হতো। তাই সবাইকে প্রশিক্ষণে পাঠানো যেতো।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিসের নবীন অফিসাররা সরাসরি একাডেমিতে যেতেন, তবে তি নভাগ হয়ে ----
১. সিএসপি অফিসার ও ফরেন সার্ভিসের নবীন অফিসাররা যেতেন লাহোর সিভিল সার্ভিস
একাডেমি, পশ্চিম পাকিস্তানে;
২. পুলিশ অফিসাররা সারদা পুলিশ একাডেমি,
রাজশাহী, পূর্ব পাকিস্তানে;
৩. অন্যান্য নবীন অফিসাররা লাহোর ফাইনান্সিয়াল একাডেমিতে।
১৯৮১ ব্যাচে সব ক্যাডার মিলিয়ে মোট অফিসার ছিলেন ১১৩ জন। এদেরকেও দুভাগে ভাগ করে, ৫৫ জনকে সরাসরি প্রশিক্ষণে ও অন্যদেরকে পদায়ন দিয়ে পাঠানো হয়।
১৯৮২ ( নিয়মিত) ব্যাচের/ আমাদের ব্যাচের প্রথমে মোট অফিসার ছিলেন ২৮১ জন। তন্মধ্যে ৪৭ জনকে সরাসরি কোটায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। অন্যদেরকে পদায়ন দিয়ে কাজে পাঠানো হয়। আমি ওই ৪৭ জনের একজন। আমরা আগে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তবে সবার মগজে প্রশিক্ষণের সুবার্তা সম্ভবত পৌঁছে নি। কেউ কেউ পরে পদ-পদবি লাভের জন্য ভীষণ মরিয়া হয়ে ওঠেন। কোটার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সুবার্তা তাদের মগজে পৌঁছুলে হয়তো এমনটি হতো না।
সবাই আমার প্রিয় মুখ রাকিব স্যার ও সামসুল হক স্যারের মতো আদর্শ মানুষ হয়ে উঠুন।
লেখক : একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিব