প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অন্তরায় - দৈনিকশিক্ষা

প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অন্তরায়

সাফিনাজ আক্তার সুভা |

প্রতিবন্ধী শব্দ শোনামাত্রই আমাদের একটি স্থবির দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়ে ওঠে। অথচ দেশে সামগ্রিক বা সর্বাত্মক উন্নতির জন্য সর্বস্তরের মানুষের শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রবাহমান উন্নয়ন বা বিস্তার প্রয়োজন। কয়েকদিন আগেই (৩রা ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হলো। আমাদের দেশের প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ অর্থাৎ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত অথবা দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে এমন মানুষের মাঝে নানা প্রতিবন্ধী শিশু-নারী-পুরুষ রয়েছে, যাদের বিষয়ে সহযোগিতার মানসিকতা সবস্তরেই এক। প্রতিবন্ধী মানেই যেনো অবহেলা আর দয়ার সহাবস্থান, যে সমস্ত পরিবার বা ব্যক্তি নানা চড়াই উৎরাই পার করে শিক্ষার জন্য স্বাভাবিক জীবনের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য এগিয়ে আসেন কিন্তু তারা খুঁজে পাননা সুনির্ধরিত প্লাটফর্ম। কেনোনা একজন স্বাভাবিক শিশুর শিক্ষা এবং একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর শিক্ষার পরিধি এক নয়। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা চলছে অনেকটা স্বেচ্ছা মাধ্যমে।

বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের সহযোগিতার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি এবং নানা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধীর কথা বলা হয়েছে। যেমন- ১. অটিজম ২. শারীরিক প্রতিবন্ধী ৩. মানসিক ৪. দৃষ্টি ৫. বাক ৬. বুদ্ধি ৭. শ্রবণ ৮. শ্রবণ-দৃষ্টি  ৯. সেরিব্রাল পালসি ১০. ডাউন সিনড্রোম ১১. বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা এবং ১২. অন্যান্য প্রতিবন্ধীতা। সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের যতোটুকু যত্ন-সহযোগিতা  প্রয়োজন ততোটুকু পূরণের কাছে যাওয়া এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই তাদের সীমাবদ্ধতা অসীম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি মাইলফলক ‘সায়মা ওয়াজেদ পুতুল’। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুকন্যা। তিনি যেনো অটিস্টিক শিশু মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার বলিষ্ঠ উচ্চারণের কারণে আজ আর কেউ অটিটিস্টক শিশুকে ঘরের কোনে লুকিয়ে রাখেন না কিংবা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন না। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ অটিস্টিক শব্দটা শিখেছে-বুঝেছে এবং কোনো একটা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। 

অটিজম নিয়ে সামাজিক বিপ্লব ঘটানোর অন্যান্য প্রতিবন্ধীরা কঠিন প্রতিবন্ধকতায় রয়ে গেছে; প্রত্যেকটি পরিবারের মধ্যে এখনো সচেতনতার অভাব। দারিদ্র্য যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের কাছে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা যেনো একটি বিলাসিতা মাত্র। যেসব সৌভাগ্যবান প্রতিবন্ধীরা তাদের পরিবারের একান্ত চেষ্টায় সকলের দয়া-দাক্ষিণ্য, অবহেলা এবং করুণার দৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে আসেন, তাদেরও কোথাও এসে থেমে যেতে হয়। কারণ, সমাজের মূলধারার শিক্ষা ও স্কুলগুলোতে সব ধরনের চলাচলের যথেষ্ট ঘাটতি ও কমতি রয়েছে। শিক্ষার অধিকার, মৌলিক অধিকার হলেও এখনো দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় বিষয়টা কল্যাণের দৃষ্টিতে দেখা হয়।  প্রত্যেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার বিষয়-শিক্ষা সূচি হবে আলাদা। এজন্য আমাদের মানবিকভাবে চিন্তা করতে হবে। তৈরি করতে হবে আলাদা পাঠ্যসূচি ও শিক্ষক। স্কুলে এসেই তারা পাবে বিভিন্ন সেবা। সেটি থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। 

শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করলেই আমরা কেবল উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা শুরু করি, আমাদের জল-কাদা মাটিতে যে মানুষ বেড়ে ওঠে তার সমসত্ব শিক্ষার সমাধান তার চারপাশের মানুষ ও প্রকৃতির, মাঝেই লুকিয়ে থাকে। আমাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে তা আহরণ করতে হয়। এজন্য দেখা যায় প্রতিটি প্রতিবন্ধী মা দিন শেষে একেকটা স্কুল খুলে বসেন, যেন বাচ্চাকে হলেও কিছু শেখানো যায়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ১. নাজনীন বেগম ইভা (রিহ্যাবিটিশন হোম ফর অটিস্টিক অ্যান্ড মেন্টালি রিটার্টেড-আর এইচ এ এম) ২. ডেমনি রহমান-পিএফডিএ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট ৩. ড. রওনক হাফিজ এ ওব্লিই এফ (অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউনেডশন) প্রতিবন্ধীদের নিয়ে প্রতিদিনই কিছু কাজ অবশ্যই এগিয়েছে তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।  একজন পুতুলের উচ্চারণে যদি সামাজিক বিপ্লব ঘটে থাকে; একেক লড়াকু মায়ের চেষ্টায় যখন এক-একটা প্রতিবন্ধী স্কুলের ভিত্তি স্থাপিত হয় তবে প্রত্যেক ঘরে ঘরে এমন স্কুল খোলা উচিত। আসুন আমরা সচেতন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। প্রতিবন্ধকতা-সীমাবদ্ধতার বিপরীতে প্রতিকার সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসি। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য দয়া বা করুণ প্রয়োজন নেই, একটি সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত ও সম্মান জরুরি। বিভিন্ন শিশুদের জন্য অভিন্ন পদ্ধতি নয়, বিভিন্ন পন্থায় শিক্ষা, স্কুল গড়ে তুলি। সরকার করতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা, একনিষ্ঠতা ও সচেতনতা তা করতে পারে।

সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী শিশুরা উপযোগী শিক্ষা পাচ্ছেন না। স্কুল-কলেজে প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষা দিতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচেছ। এতে প্রতিবন্ধী শিশুরা স্কুলে কয়েক শ্রেণি পড়ার পর ঝরে পড়ছে। একদিকে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা দিতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের যেমন অভাব, অন্যদিকে শিক্ষাগ্রহণের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্কুল-কলেজে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি নেয়া হয় না। শিক্ষকরাই প্রতিবন্ধী শিশুকে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করতে নিরুৎসাহিত করেন। তারা বলে থাকেন ও পারবে না, সবার সঙ্গে মিশতে পারবে না, সবার মতো বুঝবে না ইত্যাদি। শিক্ষকদের প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে ন্যূনতম একটি প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বইসহ শিক্ষকের ব্যবস্থা থাকলেও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী কোনো শিক্ষক নেই। ফলে এই স্তরের শিক্ষার্থীরা কিছুদিন স্কুলে গেলেও ক্লাসের পাঠ বুঝতে না পেরে পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। 

দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিলো ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে। যদিও স্কুলগুলোতে সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে ভর্তিই নেয়া হয় না। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য কিছু ব্যবস্থা আছে তবে তা সীমিত। যেমন সমজাসেবা অধিদপ্তর ৬৪টি সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেখানে আসন ৬৪০টি। আর ৮টি জেলায় পরিচালিত শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৭২০টি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ঢাকা ও চ্ট্রগ্রাম দুটি স্কুল রয়েছে। অন্যান্য জেলায় নেই। আর বেসরকারিভাবে পরিচালিত ৭২টি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন অধিদপ্তর থেকে দেয়া হয়। এর বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে মাসে ৭৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা উপবৃত্তি দেয়া হয়। 

কখনো কখনো শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার পরও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী শারীরিক প্রতিবন্ধী হৃদয় সরকার বলেন, ইচ্চা ও যোগ্যতা থাকার পরও তিনি জাপানি ভাষা বিষয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের উচ্চতর কোর্সে ভর্তি হননি। কারণ, ভাষা ইনস্টিটিউটের ভবনে লিফট নেই। এই একটিমাত্র উদাহরণ অনেক কথা বলে। আমাদের শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অমরা জানি, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছে নতুন কারিকুলাম সেখানে প্রতিবদ্ধিতার বিষয়টি কতোটা ও কীভাবে স্থান পেয়েছে এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষন হচ্ছে এবং হয়েছে তাতে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক কোনো খবর শুনছি না। তবে, পাঠ্যবইয়ের কিছু পাঠে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যে উৎসাহ দিতে হবে সে ধরনের কিছু লেসন আছে। জরিপ বলছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের (৫-১৭ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। মোট ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে বয়স অনুযায়ী অন্য শিশুদের তুলনায় তারা শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে। বিষয়গুলোর দিকে  যথাযথ কর্তৃপক্ষসহ দেশের সচেতন শ্রেণিকে কার্যকরীভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাফিনাজ আক্তার সুভা, সাবেক শিক্ষিকা, পশ্চিম রামপুরা, ঢাকা 

পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ - dainik shiksha পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম - dainik shiksha ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036208629608154