হেফাজতে ইসলাম ও ৬টি ইসলামি দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন।
শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠক হয়। এর আগে বেলা তিনটায় যমুনায় যান ইসলামি দলগুলোর নেতারা।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিকেল চারটার দিকে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি সময় যাতে না থাকেন, সেই প্রস্তাব আমরা দিয়েছেন। এ ছাড়া একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছি। নির্বাচনে অযথা কালবিলম্ব যেন না করা হয়, সেটা উল্লেখ করেছি।
মামুনুল হক বলেন, ইসলামি দলগুলোর এমন প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমত পোষণ করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের দিকে যেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
যৌক্তিক সময়টা কত দিনের-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, যৌক্তিক সময়ের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি।
তিনি জানান, বৈঠকে হেফাজতে ইসলাম সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফতে মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলনের নেতারা যোগ দেন।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিটি দল সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে জানিয়ে মামুনুল হক বলেন, মৌলিকভাবে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী সব ভোটারের প্রতিনিধিত্ব যাতে জাতীয় সংসদে নিশ্চিত করা যায়, সে ধরনের একটা মৌলিক পরিবর্তনের সংস্কারের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যে ব্যবস্থা এবং যেখান থেকেই স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব, এই জায়গায় যেন ভারসাম্য তৈরি করা হয়, সেই প্রস্তাব দেয়া হয় বলে জানান মামুনুল হক।
তিনি জানান, হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মামলা এবং শত শত ব্যক্তি হতাহত হয়েছেন, অনেকে নিখোঁজ—তাদের সন্ধানে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সব হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। যারা দায়ী, যারা নির্দেশদাতা তাদেরও যাতে বিচারের মুখোমুখি করা যায়, সে দাবি জানিয়েছেন তারা।
মামুনুল হক আরও বলেন, ইসলামবিরোধী কোনো আইন যাতে প্রণয়ন করা না হয়, আমরা সেই প্রস্তাব দিয়েছি। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের মামলা নির্বাহী আদেশ অথবা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেন প্রত্যাহার করা হয়, সে জন্য আমরা এক মাসের সময়সীমা চেয়েছি।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। এই বৈঠকে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বে দলটির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদসহ চারজন ছিলেন।
অলি আহমেদ বলেন, এলডিপির পক্ষ থেকে আমরা ৮৩টি সুপারিশ করেছি। সুপারিশগুলো ব্যক্তিগত সুবিধা, দলীয় উপকার এবং রাজনৈতিক ফায়দার জন্য না।
তিনি বলেন, বৈঠকে আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি। প্রশাসনে বদলি নয়, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদেরকে আটক করে বিচারের মুখোমুখি করার কথাও বলেছি।
এলডিপির চেয়ারম্যান বলেন, পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সংসদ নির্বাচন-এগুলোর একটা সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করার কথা বলেছি। তবে সংস্কারের আগে নির্বাচন বাঞ্ছনীয় নয়।
অলি আহমেদ বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের সময় জনগণের মানবাধিকার ছিলেো না, স্বাধীনতা ছিলো না। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, শাস্তি দিতে হবে।
একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ দাবি উপস্থাপন করে দলটি।
মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, আমরা পিআর (সংখ্যানুপাতিক) সিস্টেমে যে নির্বাচন.... যেটা সব শাখার, সব ধরনের মন-মানসিকতার লোক সম্পৃক্ত থাকবে। এখানে ভোট হবে, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হবে। দল ও মার্কা থাকবে। জনগণ ভোট দিবে, যে দল যেভাবে ভোট পাবে সে অনুযায়ী তাদের প্রতিনিধি সংসদে থাকবে, দেশ পরিচালনা করবে। সেখানে সবার সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে। এখানে কোনো বৈষম্যমূলক অবস্থা সৃষ্টি করার মতো কিছু থাকবে না।
রেজাউল করিম বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার প্রায় ১৬ বছর তাদের মনগড়া দলীয়করণ, বিশেষ করে ২০১৪, ১৮ ও ২৪ এর নির্বাচনের সময় প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেছে, মিডিয়াসহ যারা সহযোগিতা করেছে তাদের অন্যায় চিহ্নিত করে নির্ভরযোগ্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, সুন্দরভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সর্বত্র ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। এসব জায়গা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন দিলে আগের ধারাটাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
কতদিনের মধ্যে নির্বাচন, এমন কোন সময়সীমার কথা জানিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বলেছি খুব শিগগিরই। কিন্তু ব্যাপারটা তো আমাদের হাতে না। একদিন, দুই দিন নির্ধারণ করে বলাও যায় না। তবে বলছি খুব শিগগিরই সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন দিতে।
এ সময় প্রতিনিধি দলে আরো উপস্থিত ছিলেন দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনূস আহম্মেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম-মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম।