আইন পেশা অতীব মহৎ। কিন্তু, সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন কতিপয় আইনজীবীর অতিশয় দলবাজি, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের পদ-পদবীজনিত ক্ষমতার চর্চা, অপেশাদার মনোভাব ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণে এই মহান পেশা আজ নানা প্রশ্নের মুখে।
বারোয়ারি উদ্যোগে পরিচালিত ইন্টারনেট ভিত্তিক উন্মুক্ত কোষ উইকিপিডিয়ায় বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী সাহেবের পেশার বর্ণনা এরকম : ‘সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। রাজনীতিবিদ।’
গত সপ্তাহের দৈনিক আমাদের বার্তার একটি খবর অনুযায়ী, এই রিজভী সাহেব এলএলএম পরীক্ষা দেবেন কারাগারে বসেই। তিনি যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষাটি দেবেন সেটির বিরুদ্ধে মূল সনদে ইংরেজিতে ভাইস-চ্যান্সেলর বানান ভুলসহ নানা অভিযোগ ছিলো। এখনও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নাই। শুধু রিজভী সাহেব নন, গত দশ বছরে কম পক্ষে এক লাখ বিএনপি নেতা এমন মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়েছেন। এখনও নিচ্ছেন। এসব নেতার বিরুদ্ধে কয়েকডজন করে মামলাও রয়েছে।
একই ঘটনা দেখেছি ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়েও । তখন সনদ নিতেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এমন ডিগ্রি নেয়া নেতারা শুধু সনদেই ক্ষান্ত হন না। তারা বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষাও দেন। পরীক্ষায় নকলের সুযোগ না পেলে প্রশ্ন কঠিন হওয়ার অজুহাতে কেন্দ্রে ভাঙচুরও চালান। তবে ভাঙচুর কাণ্ডের দায় এককভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নয়। এখানে আওয়ামী লীগপন্থীরাও সমানে সমান।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক লাঞ্ছনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন। এ বিষয়ে হাইকোর্ট রুলও দিয়েছেন। অভিযোগ ওঠা আইনজীবী নেতাদের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
২. ল পয়েন্টে কথা বলে জামিন পাওয়া বা মামলা লড়াই করার হার কতো তা আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। জামিন ব্যবসা নিয়ে বিচারিক থেকে উচ্চ আদালতের নানা অঘটনের খবর পাঠক জেনেছেন প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের একাধিক লেখায়।
৩. ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল-এর সচিব এবং সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. ওয়াহিদুজ্জামান শিকদার সাক্ষরিত এক চিঠি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী মিশনে পাঠানো হয়েছে। এতে কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের এক রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এলএলবি প্রোগ্রামে প্রতি সেমিস্টারে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার আইনগত সুযোগ নেই।’
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে অমন রায়ের প্রেক্ষাপটটা আলোচনা করার আগে একটু দেখে নিতে হবে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা প্রতিবেদন। যেখানে বলা হয়, ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫টির উদ্যোক্তা বা মালিকানা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। পাঁচটি বন্ধ। আর বাকী ৪৫টির মালিকানা বা উদ্যোক্তা বিএনপি-জামাতপন্থীরা।
গত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি-জামাত। তাদের লাখ লাখ নেতা-কর্মী বিভিন্ন অপরাধে আসামি। তাদের একটা বড় অংশ তাদেরই অনুমোদিত বা মালিকানাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আইনের সনদ নিয়েছেন। বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়ে আইনজীবী তালিকাভুক্ত হয়েছেন। বার সমিতিগুলোর নির্বাচনের ফল দেখলে আমার এই তথ্যের হিসেব মেলাতে পারি। রিজভী সাহেব একটা উদাহরণ মাত্র।
বার কাউন্সিল পরীক্ষায় বই দেখে লেখার ইতিহাস পুরনো। কিন্তু এতে লাগাম টানেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অন্যরা। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, আইনজীবীর সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে।
এরপর আগের মতো নিয়মিত বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেয়া হয়নি। গত কয়েকবছরে পদ্ধতি আধুনিকায়নসহ অনেক উন্নতি হয়েছে পরীক্ষায়। তবে, এতে মন খারাপ হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো থেকে আইনের সনদধারীদের। তারা গত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের পরীক্ষায় নকল করতে না পেরে ভাঙচুর করেছেন। গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকেই।
৪. স্বাধীন পেশা সাংবাদিকতা। মূলধারার সাংবাদিকদের জন্য রয়েছে ওয়েজবোর্ড। ওয়েজবোর্ডের গঠনের প্রধান থাকেন একজন বিচারক। ওয়েজবোর্ডভুক্ত একজন সাংবাদিক একইসঙ্গে অন্য একটি মিডিয়ায় চাকরি করতে পারেন না। তাঁকে হতে হয় ফুল টাইমার। তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি কোনো সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেও পারেন না। চাপ দিতে পারেন না। কিন্তু আইনজীবীরাও তো পেশাজীবী। তারা আইন ব্যবসায় নিযুক্ত। চোর-ডাকাত-সাধু সবার পক্ষে-বিপক্ষে লড়তে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকরা সংবাদব্যবসায়ী নন। তারা ওয়েজবোর্ডভুক্ত পেশাজীবী। কিন্তু, উকিল বা আইনজীবীদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত নেই। এক মামলায় ১৬/১৮ কোটি টাকা ফি নিলেই হয়তো জানাজানি হয়। উকিলদের ফি নেয়ার কোনো মানি রিসিট থাকে না। এই মানি রিসিট প্রথা চালু করাও জরুরি। ডাক্তার ও ডেন্টিস্টদের জন্য বিএমডিসি রয়েছে। তারা শাস্তি দেন। কিন্তু অপেশাদার, অশালীন, উচ্ছৃঙ্খল ও হুমকিমূলক কাজ করে কয়জন আইনজীবী শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন তা কেউ জানে না।
৫. শিক্ষাবোর্ডের বিধান অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তাদের পেশা ব্যতীত অন্য কোনো লাভজনক পেশায় যুক্ত হতে পারেন না। এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী তাদের পেশা ব্যতীত অন্য কোনো অলাভজনক কাজেও যুক্ত হতে পারেন না। জাতির পিতার দেয়া স্বায়ত্ত্বশাসনের অপব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক একাধিক চাকরি করে গেলেও সেটা ব্যতিক্রম। সর্বত্র সমোলোচিত।
৬. বিচারিক আদালতের বিচারককে অমন হুমকি-ধমকির ঘটনা কি নতুন? মোটেই না। বিগত কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটিতেই আক্রমণকারী ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা। অথবা আইনজীবী পরিচয় ছাড়াও তার রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের কোনো সংগঠনের বড় পদ। অথবা স্থানীয় স্ট্যাম্প বা অন্য কোনো প্রভাবশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অপরপক্ষে, কঠিন প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুডিসিয়াল সার্ভিসের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চাকরি করতে হচ্ছে বিচারকদের। বদলি হয়ে এসব স্থানীয় লাগামহীন ক্ষমতাবানদের রাজ্যে চাকরি করতে যেতে হচ্ছে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের চার বছরের অনার্স ডিগ্রি ছাড়া বিচারক হওয়ার পরীক্ষায় অংশই নেওয়া যায় না। কিন্তু বেসরকারি আইন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই/তিন বছরের ডিগ্রি নিয়ে আইনপেশায় যুক্ত রয়েছেন হাজার হাজার আইনজীবী। আচরণ, বুলি, শিক্ষা-দীক্ষা ও চাকরির বিধিবিধান মানায় আকাশ পাতাল ফারাক থাকা দুই দলের কেতাবি নাম বেঞ্চ ও বার। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বার ও বেঞ্চ মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
আমার প্রশ্ন রইলো, মৌলিক শিক্ষাদীক্ষা ও চাকরির বিধানে দুই দলের এমন ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেন এমন বলা হয়? দুই পক্ষের সম্পর্কটা একেবারেই পেশাগত। কারো জন্য কারো জায়গা ছাড়ারও দরকার নেই, আবার সীমাও অতিক্রম করার দরকার নেই। আইনজীবীদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
এ জন্য আমরা সবিনয়ে প্রধান বিচারপতির মনোযোগ আকর্ষণ করবো। তিনি সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত হয়ে) আদেশ দিয়ে আইনজীবীদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দিতে পারেন। চাইলে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েও কাজটিকে এগিয়ে নিতে পারেন। আমরা তার সুবিবেচনার অপেক্ষায় রইলাম।