বিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও জাতীয়তাবাদী স্বপ্নদ্রষ্টা প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর জন্মদিন আজ। তিনি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বর্তমান খুলনা এবং তদানীন্তন যশোর জেলার অন্তর্গত রাড়ুলি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রফুলচন্দ্র ছিলেন হরিশচন্দ্র রায়ের তৃতীয় পুত্র। তার পিতা ছিলেন একজন ছোটখাটো জমিদার। উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে প্রফুল্ল চন্দ্র ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে হেয়ার স্কুলে (কলকাতা) ভর্তি হন। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তিনি দুবছরের বেশি সেখানে লেখাপড়া করতে পারেন নি। দুবছর বিরতির পর তিনি পুনরায় আলবার্ট স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন এবং সেখান থেকে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি মেট্টোপলিটান ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে এফএ পরীক্ষায় পাস করেন। তিনি ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি এবং ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রসায়ন শাস্ত্রে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল চন্দ্র তার বিখ্যাত History of Hindu Chemistry গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে বইটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির ব্যাপক জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন। মারকিউরাস নাইট্রাইট তৈরির ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে প্রফুল্ল চন্দ্র একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। বিজ্ঞান গবেষণায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ব্রিটিশ সরকার প্রথমে তাকে রাজকীয় খেতাব সিআইই এবং পরে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নব প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স’-এ যোগদান করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের জেনারেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
বিজ্ঞানের উন্নয়নে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা, বেনারস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরপর তাকে সম্মানসূচক ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তার আত্মজীবনী Life and Experiences of a Bengali Chemist-এর প্রথম খণ্ড এবং ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নের ‘পালিত অধ্যাপক’ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি একজন ‘এমেরিটাস’ প্রফেসর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
বিজ্ঞান জগতের বাইরে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বিশেষ আগ্রহ ছিলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিল্পকলা ও বিজ্ঞান চর্চায় অনুরাগী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রচুর লিখেছেন এবং অন্যদেরকেও মাতৃভাষায় লেখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। অনেক স্কুল ও কলেজ তার কাছ থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পেয়েছে। একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি আরো চেয়েছিলেন যে, শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে বাঙালিরা এগিয়ে আসুক। তিনি নিজে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ নামক একটা কেমিক্যাল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এটি ছিলো বাঙালিদের দ্বারা স্থাপিত ও পরিচালিত অগ্রগামী শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহের একটি। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রয়াত হন।