বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিলো পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুরাপ গ্রামে। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জামালপুর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং পাটনা কলেজ থেকে এফএ ও ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে আইন পড়তে বিলেত যান এবং ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফেরেন। তখন থেকেই ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দার্জিলিং, রংপুর, গয়া প্রভৃতি স্থানে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত থাকেন। নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকার সম্পাদনা করতে শুরু করেন। পরে এই মহারাজেরই প্রচেষ্টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এখানে অধ্যাপনায় লিপ্ত থাকেন।
ছাত্রাবস্থায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে প্রভাতকুমারের সাহিত্য জীবনের শুরু। পরে গদ্য রচনায় হাত দেন। ‘শ্রীমতী রাধামণি দেবী’ ছদ্মনামে লিখে কুন্তলীনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এক বার ‘শ্রীজানোয়ারচন্দ্র শর্মা’ ছদ্মনামে তার রচিত নাটক ‘সূক্ষ্মলোম পরিণয়’ মর্মবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রদীপ, প্রবাসী ও ভারতী পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার রচিত ১৪ টি উপন্যাস ও মোট ১০৮ টি গল্প নিয়ে ১২ টি গল্প-সংকলনের সম্ভার আছে বাংলা সাহিত্যে। তার প্রথম উপন্যাস ‘রমাসুন্দরী’ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ধারাবাহিক ভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রকাশিত ‘রত্নদীপ’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে । এটি নাট্য ও চলচ্চিত্ররূপে জনপ্রিয় হয়েছে। সরল ও অনাবিল হাস্যরসের গল্পলেখক হিসেবে প্রভাতকুমার সমধিক প্রসিদ্ধ। সাধারণ আটপৌরে জীবনের লঘু ও দুর্বল দিকগুলো হাস্যরসে পরিবেশিত হয়েছে। বাঙালি জীবনের সুখ ও দুঃখের জীবন দোলার ছন্দে ছন্দময় হয়ে সার্থক হয়েছে।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন। সাহিত্যজীবনের শুরুতে প্রভাতকুমার কবি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথই তাকে গদ্য লিখতে উৎসাহিত করেন। দুজনে বাংলাসাহিত্যে সমকালীন হলেও রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি আর প্রভাতকুমার সফল ও দক্ষ গদ্যকার। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ ছোটগল্পগুলো যেখানে কল্পনাপ্রসূত, প্রভাত কুমারের লেখা সেখানে বাস্তবসত্যে নিষ্ঠাবান। প্রভাতকুমার তার গল্পে ভাব-উচ্ছ্বাস হ্রাস করে তুলে ধরেছেন বাস্তবসত্যকে। যা মানুষের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের শৈল্পিকগুণে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য ‘প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠগল্প'’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন -
‘রবীন্দ্র-কবিমানসের স্বমন্দাকিনীই ছোটগল্পে মর্ত্যভাগীরথীরূপে মানুষের কাছে আনন্দ-বেদনায় কলনাদিনী, তাই তার পাবনপ্রবাহে মৃৎপুত্তলিকাও ক্ষণে ক্ষণে দেবতার অমর মহিমায় দীপ্তমান। প্রভাতকুমারের যমুনা মৃত্যু সহোদরা কালিন্দী, তার নির্মল জলে পার্থিব জীবনেরই স্বমহিমচ্ছায়া প্রতিবিম্বিত।
সূক্ষ্ম জীবনবোধের কারণেই রবীন্দ্রনাথের কালে থেকেও বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেতে প্রভাতকুমারের এতটুকু বেগ পেতে হয়নি। বিচিত্রমুখী গল্পের জন্য তিনি সমকালেই খ্যাত হয়েছিলেন ‘বাংলার মপাসাঁ’ নামে।
তার গল্পগুলি ইংরাজীতেও অনুদিত হয়েছে। তবে তিনি ছোটগল্পকার হিসাবে যতখানি সফল ঔপন্যাসিক হিসাবে ততটা নন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কুল পাঠ্য হিসেবে কিছু রচনা, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হন ।