যে পণ্যটি মানুষের নিত্য সময়ের ব্যবহৃত অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে সেটা পুরোপুরিভাবে বর্জন করতে গেলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। পাশাপাশি তার জায়গায় বিকল্প পণ্য হাতের নাগালেও থাকা দরকার। বাস্তবতা এটাই যে, পণ্যটি নিষিদ্ধ হলেও সবার হাতে হাতে। পণ্যটি আর কিছুই নয়, সবার পরিচিত পলিথিন ব্যাগ। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও দিনে দিনে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার আরো বেড়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিন নিষিদ্ধ আইন কার্যকর করতে সোচ্চার হয়েছেন।
তাই প্রাণ ও পরিবেশের শত্রু পলিথিনের উৎপাদান, বাজারজাতকরণ, বেচাকেনা ও ব্যবহার বন্ধে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি নিজেও একজন স্বনামধন্য পরিবেশবিদ এবং প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় নিজের অবস্থান ও সংগঠন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতঃপর ১ নভেম্বর থেকে পুরো দেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। এই নিয়ম কার্যকর করতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছে।
কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার আদৌ কি বন্ধ করা সম্ভব হবে? পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণার পর বিগত সরকারগুলো কয়েক দফায় পলিথিনের বিস্তার ও ব্যবহার বন্ধে নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলো। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা যায়নি। এক কথায় পলিথিন বর্জনের আহ্বানে সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা ছিলো না। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারও পলিথিন বর্জনের ডাক দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, আগের সরকারগুলোর চেয়ে বর্তমানের অন্তবর্তীকালীন সরকারের পলিথিন বর্জনের ডাকে পার্থক্য তথা আরো বেশি জনসম্পৃক্ততা না থাকলে পলিথিন বর্জনের ডাকে সাড়া মিলবে না।
গতানুগতিক ধারাই নয়, নতুনভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেমন-কাগজের ব্যাগ, পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে জনসাধারণের অভ্যাস বাড়াতে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন সাইজের কম মূল্যের পাটের ব্যাগ বাজারে রাখতে হবে। পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিকল্প পেশার সন্ধান দিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন দিয়ে দেশের প্রতিটি বাজারে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে বছরব্যাপী ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে একদিনে সুফল মিলবে না, যতোদিন সুফল না পাওয়া যাবে ততোদিন পলিথিন বর্জনের ব্যাপারে যা যা করা দরকার সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে।
নিষিদ্ধ পলিথিন বর্জনের ডাকে হয়তো শুরুতেই কিছু তোড়জোড় দেখা যাবে-এটা সত্যি, তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। বর্তমানে পাটের বস্তায় চাল বাজারজাতকরণ বাধ্যতামূলক হলেও বাজারে বেশিরভাগ চালের বস্তার উপরিভাগ প্লাস্টিকের দেখা যাচ্ছে। পলিথিন সবচেয়ে ক্ষতিকর ও খারাপ প্লাস্টিক। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময় পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শুরু হয়। নব্বই এর দশকে বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যাপকতা লাভ করে। প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বিবেচনায় বাধ্য হয়ে তৎকালীন সরকার ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু নিষিদ্ধ করেও এর ব্যবহার থামানো যায়নি। বরং পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার বেড়েছে। পলিথিনের ক্ষতি বলে শেষ করা যাবে না। পলিথিন ফসল উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত করে। জলাবদ্ধতা তৈরি করে। নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর জমে নদী দূষণ ত্বরান্বিত করে। সমুদ্র দূষণের আরেক নাম পলিথিন ও প্লাস্টিক।
মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য মহাবিপদের কারণ। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণির শরীরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে ক্ষতির কারণ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে পলিথিন একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ফ্রিতে পাওয়ায় এর যথেচ্ছ ব্যবহার থামানো যাচ্ছে না। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে শুরুর দিকে এ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। পলিথিনে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় সে তুলনায় ভর্তুকি অনেক বেশি লাভজনক।
পলিথিন ব্যাগ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি একথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। তারপরও প্রকাশ্যে এর ব্যবহার চলছেই। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে পলিথিন ব্যাগ এবং এটি সহজে বহনযোগ্যও বটে। প্রশ্ন হলো, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ প্রকাশ্যে বিস্তারের দায় কার? জনসাধারণকে এর জন্য দায়ী করা মোটেও সমীচীন হবে না। পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি এবং বিক্রয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, এ দায় তাদের।
পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে যারা বা যেসব কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে, এ দায় তাদের। বাজারের দোকানদার বা বিক্রেতা সহজেই ক্রেতার নিত্যপণ্য পলিথিনে ভরে দিচ্ছেন। তা ছাড়া পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে এমন সহজলভ্য ও সস্তা কোনো ব্যাগের সন্ধান জনসাধারণ পর্যায়ে এখনো সেভাবে পৌঁছায়নি।
ফলে খোলাখুলিভাবে চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। আমরা পলিথিন ব্যাগকে পরিবেশের শত্রু বলে গণ্য করে থাকি। আর এই শত্রু প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঢুকছে। কাগজের ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ কিংবা পাটের ব্যাগ সহজপ্রাপ্য ও কম দাম না হওয়ায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
পলিথিন শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ফলে পানিদূষণসহ নানা রোগের বিস্তার ঘটছে। অতিরিক্ত পলিথিন ব্যবহারে ক্যানসারে রোগ-ব্যাধি ও অকাল মৃত্যু বাড়ছে। পলিথিন বিক্রিয়ার দূষণ শরীরের স্বাভাবিক হরমোন প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান করে। লিভার, কিউনি সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভবতী মায়েদের নানা জটিলতা তৈরি করে এই পলিথিন। কোপেনহেগেন ভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’- এর তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বে ৫ লাখ কোটি টন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাত্র ১ শতাংশই পুনর্ব্যবহারের জন্য রিসাইক্লিং করা হয়। পলিথিনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব কমই জানে।
‘পবার’ (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে, যেগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া হচ্ছে। এক তথ্য মতে, ঢাকার ৭০ শতাংশ জলাবদ্ধতার কারণ পলিথিন। তথ্য মতে, ঢাকায় প্রায় ১০০ কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পলিব্যাগ জমে নগরীর স্যুয়ের, স্টর্ম স্যুয়ের, নালা-নর্দমাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। পলিথিনে খাদ্যদ্রব্য রাখলে তা দ্রুত রাসায়নিক বিষক্রিয়া তৈরি করে। ময়লার ভাগাড়ে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে পলিথিন ব্যাগ পোড়ানোর দৃশ্যও চোখে পড়ে। এর ফলে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি স্বরূপ। পলিথিন ব্যাগ কোথায় উৎপাদন হয়, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে কারা জড়িত একটু খোঁজ-খবর নিলেই তা জানা অসম্ভব নয়। পাটের সোনালী ব্যাগ ও টিস্যুর ব্যাগ বাজারে আসার কথা শোনা যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ব্যাগ যতো দ্রুত বাজারে আসবে জনসাধারণের জন্য ততোই সুবিধা হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের শাস্তি দুই বছরের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানা। একসঙ্গে দুটি দণ্ডও হতে পারে। আবার বিক্রি, প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিবহন বা ব্যবহারের অপরাধে শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা দুটোই। কতো সুন্দর ও সময়োপযোগী আইন আছে, অথচ এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। বাস্তবিক পক্ষে এই আইন উৎপাদনকারী, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জানা আছে বলে মনে হয় না। জানা থাকলে আইনের ভয়ে অন্তত প্রকাশ্যে পলিথিনের ব্যবহার হতো না। জনসাধারণের মধ্যে পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত ও সচেতন করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার দায় কারো একার নয়, আমাদের সবার। পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। প্রাণ ও পরিবেশের শত্রু পলিথিন বর্জনে এগিয়ে আসুন।
লেখক: শিক্ষক