পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। সব দেশেই সব জায়গাতে শিক্ষকের কদর ও মূল্যায়ন বেশি। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে হিসেবে উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা একেবারেই নগণ্য। আমাদের দেশের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন একজন সরকারি অফিসের কেরানির চাইতেও কম। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেইভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি। এজন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সুন্দরভাবে চলতে পারলেও একজন প্রাথমিকের শিক্ষককে অনেক কষ্ট করে দিন পার করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সমাজে শিক্ষক ও তার পরিবার পারিপার্শ্বিকভাবে হেয় বা অবমূল্যায়িত হবে। রাষ্ট্রকে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে একজন শিক্ষক যেনো তার পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে সমাজে চলতে পারে। একজন শিক্ষক যদি মাসের বেতনের টাকায় ঠিকমত চলতে না পারেন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারবেন না।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের দাবি প্রধান শিক্ষকদের মতো, (যদিও আদালতের রায় এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি) সহকারী শিক্ষকদেরও ১০ম গ্রেড প্রদান করা হোক। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্তরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় রেখে দেয়া হয়েছে। চরম একটা গ্রেড-বৈষম্যের শিকার হয়ে আছেন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকেরা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড নিছক কোনো দাবি নয়, এটা ন্যায্য অধিকার। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য যোগ্যতা, স্নাতক সমমান (২য় বিভাগ) বেতন গ্রেড ১৩তম। পাশাপাশি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক সমমান, বেতন গ্রেড ১০ম। পুলিশের উপ-পরিদর্শকের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক বা সমমান, বেতন গ্রেড ১০ম। হাসপাতালের নার্সদের নিয়োগের যোগ্যতা বিএসসি ইন নার্সিং, বেতন গ্রেড ১০ম। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার নিয়োগের যোগ্যতা ৪ বছর মেয়াদি কৃষি ডিপ্লোমা, বেতন গ্রেড ১০ম। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক, বেতন গ্রেড ১০ম। শিক্ষকদের এই দাবি নিয়ে মানববন্ধন, আন্দোলনসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর ও উচ্চ পদস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতেও ফলপ্রসূ বা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
শিক্ষক সমাজ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার বহুদিন থেকে। একজন শিক্ষক তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যদি না পায় তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেবেন। শিক্ষক জ্ঞান বিতরণ করবে নিজের ও পরিবারের পেট খালি রেখে নাকি অন্য কোনো ধান্ধায় লিপ্ত হয়ে। পৃথিবীতে একমাত্র আমাদের দেশের শিক্ষকেরা বিভিন্নভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলার শিকার। সমাজ বা দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে একজন শিক্ষকের অর্থনৈতিক দিক এবং বৃদ্ধি করতে হবে মান মর্যাদা। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নেয়া অসম্ভব কিছু নয়। শিক্ষকদের এই দাবি অবাস্তব অযৌক্তিক নয়। সরকারকে শিক্ষকদের কল্যাণের জন্য এবং মঙ্গলের জন্য দাবি পূরণ করতে হবে। একজন মাস্টার্স, বিএড, ডিপিএড ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষক এখনো তৃতীয় শ্রেণির ক্যাটাগরির লোক হিসেবে গণ্য হবে তা মেনে নেয়া যায় না। বর্তমান সময়ে শিক্ষকরা অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় সব কিছুতেই এগিয়ে রয়েছে কিন্তু সে তুলনায় তার বেতন স্কেল মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমাদের সমাজে মানুষ যে কাউকে সবার আগে তার বেতন দিয়ে মান মর্যাদা যাচাই বা মূল্যায়ন করে থাকে। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একজন শিক্ষককে দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। যার চর্চা যতো বেশি তার জ্ঞানের ভান্ডার ততো বেশি পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু সে শিক্ষকের যদি চর্চা করার সুযোগ না থাকে তাহলে আদৌ ভালো শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিণত করা সম্ভব নয়। শিক্ষকতা পেশায় পদোন্নতি একবারেই নেই বললে চলে। এই কারণে শিক্ষকরা কাজে কর্মে নিরাশ হয়ে পড়েন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতির সুযোগ না থাকে, তাহলে তার এই পেশার প্রতি একঘেয়েমি বা বিরক্তি চলে আসবে। যোগ্যতা অনুসারে পদোন্নতির সুযোগ রাখলে, তিনি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাবেন। এতে কাজেও যেমন গতি আসবে এবং মনেও প্রশান্তি আসবে।
শিক্ষককে যদি সঠিক মান মর্যাদা দেয়া না হয়, তাহলে অযথা কেনো তিনি কঠোর পরিশ্রম করে নিজের চিন্তাধারা বা সৃজনশীলতা প্রকাশ করবেন। একজন শিক্ষককে যদি প্রতি মুহূর্তে সংসারে অর্থের টানাপড়েনের চিন্তা করতে হয় তাহলে তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাও বোকামি। প্রত্যেক মানুষেরই জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। এখন শিক্ষকদের অর্থ ও মান-মর্যাদা যদি না থাকে তাহলে তিনি বিভিন্ন রকমের অপকর্মে বা দালালিতে লিপ্ত হবেন। শিক্ষকদের মাঝে যদি প্রেষণা সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে কীভাবে মেধা ও শ্রম দিয়ে পেশার প্রতি দায়িত্বশীল হবে। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকই শিক্ষার্থী, সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করতে পারবেন। শিক্ষক তার সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে বদলে দেবেন বিদ্যালয়ের চেহারা। শিক্ষক সমাজের গুরু, পথ নির্দেশক, আলোকিত ব্যক্তি। তাই তো বলা হয়, দাম্ভিকতাপূর্ণ তর্জন-গর্জনকারী কিংবা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কলুষিত ব্যক্তির এ মহান পেশায় দায়িত্ব গ্রহণ সাজে না।
মহান সৃষ্টিকর্তা শিক্ষকের জীবনকে আলাদা বৈচিত্র্য এবং সুখময় মাধুর্য দিয়ে সম্মানিত করেছেন। যেখানে সুখ আছে, শান্তি আছে এবং আছে আনন্দঘন উচ্ছ্বাসভরা প্রগতিশীলতা। শিক্ষকতা নামক মহান পেশায় পদার্পণকারী ব্যক্তি অবশ্যই সামাজিক ছাঁচে গড়া সুন্দর নৈতিকতা পূর্ণ আদর্শের প্রতীক হবেন। নীতিহীন মানুষ কোনোকালেই আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। কারণ, শিক্ষক হবেন সুন্দর মন ও পবিত্র আত্মার শৈলিনক দৃষ্টিভঙ্গির আধিকারী, প্রজ্ঞাবান আদর্শ মানুষ। আমাদের দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না বেতন ও মান মর্যাদা কম এবং পদোন্নতির সুযোগ নেই বলে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে সবার আগে শিক্ষকদের চাহিদা পূরণ করতে হবে। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে তাদের শিক্ষা দানে আরো বেশি উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করতে হবে। মেধাবী ছেলেমেয়েরা যেনো শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারেন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মেধাবীদের এই পেশার প্রতি আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে হলে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষকদের দেশ-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে, তাহলে তারা নিজেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
পরিশেষে, একথা বলতে চাই যে, শিক্ষকেরা আর দারিদ্র্যের খেতাব নিয়ে শিক্ষকতা করতে চান না, সমাজে অন্য দশজন ব্যক্তি যেভাবে উন্নত জীবন যাপন করে সেভাবে শিক্ষক সমাজও বাঁচতে চান। কর্তৃপক্ষকে ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষকদেরও আধুনিক যুগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সৎভাবে জীবনযাপন করতে হয়। তাই, শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো সরকার বিবেচনা করে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করবেন এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাবেন এই কামনা করি।
লেখক: শিক্ষক