প্রাথমিকে ছুটি বৈষম্য কাম্য নয় - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে ছুটি বৈষম্য কাম্য নয়

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

একই অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির বৈষম্য পরিলক্ষিত হলে, বিশেষ করে অভিভাবকদের সমস্যা পোহাতে হয়। অপরদিকে, পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটি ৭৬দিন নির্ধারণ করা হলেও কৃপণতার বন্ধনে আবদ্ধ প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়। অথচ উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ মাদ্রাসাসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের ছুটি ৭৬ দিন।

অথচ প্রাথমিকে ৬০ দিন। প্রাথমিকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের বিদ্যালয় পর্য্যায়ে ৪০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ৬০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়নকে উপেক্ষা করে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। শুধু প্রশ্নের ওপর লেখা হয়েছে ১ম/২য়/৩য় প্রান্তিক মূল্যায়ন। যা ‘পুরাতন বোতলে নতুন মদ ঢালার মতো’। শিক্ষাক্রমকে উপেক্ষা করে চালু করা হয়েছিল প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। যা ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। শিশুরা খেলাধুলা, আনন্দ বিনোদনসহ নানা স্থানে বেড়াতে ভালবাসেন। তাদের পাঠ্য বইযের চাপ কম। তারা প্রকৃতি থেকে শিখবেন। এজন্য তাদের বেশি অবসর বা বিনোদনের সুয়োগ প্রয়োজন। ছুটির মাঝে তারা সীমাহীন আনন্দ খুঁজে পান। আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি কবিতা পড়লে অনুধাবন করতে পারবো।

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।
কী করি আজ ভেবে না পাই,
পথ হারিয়ে কোন বনে যাই,
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই,
সকল ছেলে জুটি।
কেয়াপাতায় নৌকো গড়ে’
সাজিয়ে দেব ফুলে,
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেবো,
চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু
চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু
চাঁপার বনে লুটি।
আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।

শিক্ষার্থী, কর্মজীবীদের নিকট ছুটি আনন্দের। কাজের কর্মক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ছুটি বা বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এজন্য কবি বলেছেন, বিশ্রাম কাজের অঙ্গ, এক সঙ্গে গাথা, নয়নের পাতা যেন নয়নে গাথা।’ অতিরিক্ত পরিশ্রম বা পড়ার চাপ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বয়স্ক বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের একেবারে অলস বা কর্মহীন থাকাও শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর। ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে হৈ চৈয়ের মাধ্যমে আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করে থাকেন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫৪ দিন ছুটি নিয়ে রমজানে তৃতীয়-৫ম শ্রেণির ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী রোজা রেখে ক্লাস করার হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছিলো।

সে ঘটনা মনের মাঝে ভেসে উঠে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে ছুটির ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের খসড়া তালিকা দেখে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, শিখন ঘাটতি দূর করার প্রয়াসে ছুটি নিয়ে কৃপণতা। দীর্ঘ সময়ে শিক্ষকতা, শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা ও শিশুশিক্ষা নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হচ্ছে, শিখন ঘাটতি দূর না হওয়ার অন্যতম কারণ শিক্ষায় শিশু মনোবিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একেবারে শূন্য অবস্থান। এ শূন্যতা দূরীকরণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক থেকে পর্যায়ক্রমে শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর অতিক্রম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি একটানা ১৫ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পরেও আমাদের শিক্ষার্থীরাও আজও স্বাধীনতার সংগ্রামী ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। আমাদের ২টি মন্ত্রণালয় যথাক্রমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি লুকিয়ে আছে। তারা পদোন্নতিসহ স্বীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে, জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য বা জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা নিয়ে তাদের ভাবনা ও জ্ঞান দৃশ্যমান নয়। তাদের ভাবনার মধ্যে আজও বসবাস করছে বৃটিশ আমলের দারোগা-পুলিশের মানসিকতা।

কিছুদিন পূর্বে শিক্ষা প্রশাসন ক্যাডার কমকর্তারা ধর্মঘট করেছিলেন। মাধ্যমিক শিক্ষকেরা আন্দোলন করেছেন। তাদের দাবির প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইতিবাচক মনোভাব দৃশ্যমান। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে ও পুলিশি আচরণ দুঃখজনক। শুধু কি প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারী? সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কি সরকারি কর্মচারী নয়? কেনো প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের ওপর এমন নিষ্ঠুর আচরণ? 
আগামী প্রজন্মকে বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানানোর জন্য জাতীয়ও বিশেষ দিবসমূহ বাৎসরিক ছুটির তালিকায় বিদ্যালয় খোলা রাখা প্রয়োজন। ছুটির তালিকা প্রণয়নকারী সংশ্লিষ্টরা সুকৌশলে জাতীয় ও বিশেষ দিবসগুলো বাৎসরিক ছুটির তালিকায় ছুটি দেখিয়ে থাকেন।

দীর্ঘ বছরের পর বছর এই কার্যক্রম চলে আসছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। অপরদিকে শিক্ষকদের দিবসগুলো পালনের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকেন। যার ফলে শিক্ষকেরা গুটিকয়েক শিক্ষার্থী ডেকে এনে দায়সারাভাবে যেনতেন দিবসগুলো পালন করে থাকেন। বিষয়টি অনেকটা বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে দিবসগুলো যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হলো, ‘চোরকে চুরি করতে বলা আর গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকতে’ প্রবাদের মতো। 

শিক্ষার দুটি মন্ত্রণালয়ের এ অপকৌশল বন্ধ করা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট এ অজুহাতে শিক্ষকদের নন-ভ্যাকেশনাল কর্মচারীর সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষকেরা সকল সরকারি কর্মচারীর মতো তিন বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। নন ভ্যাকেশনাল কর্মচারীদের তিন বছর পর পর এক মাসের মূলবেতন ও ১৫ দিনের ছুটি দেয়া হয়। শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেতে হলে বা ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের বাৎসরিক ছুটির তালিকা হতে ১৫ দিন ছুটি দেখাতে হয়। প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন না থাকায় রমজান মাসে ছুটি থেকে ১৫ দিন দেখানো হয়ে থাকে। আরবি বছর ৩৫৫ দিন। এ পরিপ্রেক্ষিতে রমজান মাসে ছুটি দেখানোর ফলে বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষকদের ভাগ্যে তিন বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তি সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এ অবস্থায় নিরসনে জাতীয় ও বিশেষ দিবসের ছুটিগুলো গ্রীষ্মের ছুটির সঙ্গে যোগ করে ১৫ দিন করা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসারের সন্নিকটে নয়। আধা কিলো থেকে ১০ থেকে ১৫ কিলো দূরত্বে অবস্থান। এই অবস্থান থেকে প্রধান শিক্ষকের হাতে তিন দিন ছুটি রেখে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অনুমোদন নিয়ে ছুটি ভোগ দুরূহ। তিন দিন ছুটি প্রধান শিক্ষকদের হাতে রাখার যৌক্তিকতা হলো বিশেষ কোনো ঘটনা বা কারণে আকস্মিক বিদ্যালয় ছুটি দেয়া। এক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অনুমোদনের পরিবর্তে অবহিত করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত।

বিষয়টি অনেকটা প্রধান শিক্ষকদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয়ার মতো। বিষয়টি নিঃসন্দেহে মর্যাদা হানিকর। ছুটির তালিকা সংশোধনের প্রত্যাশা রইলো।

লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059051513671875