শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হলো সাক্ষরতা। সাক্ষরতা শব্দটি দ্বারা প্রকৃতপক্ষে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নতাকেই বোঝানো হয়। তবে দিন দিন এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষরতা শব্দটির ব্যপকতা বাড়ছে। এখন সাক্ষরতার সঙ্গে প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা। কারণ, কেবলমাত্র সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ দিয়ে সমাজে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হয় না। দরকার শিক্ষিত মানুষ এবং জাতি। একসময় স্বাক্ষর বলতে কেবল অক্ষর জ্ঞানের সঙ্গে নিজের নাম লিখতে পারার দক্ষতাকেই বোঝানো হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এইটুকু অর্জন করাই ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। সাক্ষরতা একটি দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের অগ্রযাত্রায় এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার সঙ্গেও সাক্ষরতার রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র। দেখা গেছে যে দেশে সাক্ষরতার হার যতো বেশি সে দেশ ততো বেশি উন্নত। সাক্ষরতা বা অক্ষরজ্ঞান অর্জন হলো শিক্ষার একেবারেই প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কারণ, এখান থেকেই বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে হয়। জ্ঞান অর্জনের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়।
আজকাল শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কারণ, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের এ অর্জন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শিশুদের শ্রম থেকে সরিয়ে পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এটা নিশ্চিত করা হলে শতভাগ শিক্ষিত জাতি হিসেবে নিজেদের বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু নিরক্ষতার হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখনো অনেক পথ বাকি রয়েছে। বিবিএস ২০২২ খ্রিষ্টাব্দকে ভিত্তি ধরে জনশক্তি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছরের মধ্যে এবং তার ওপরে যাদের বয়স তাদের সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে এ সাক্ষরতার হার ১০ শতাংশ বেশি। শহরাঞ্চলে ৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ সাক্ষরতার হারের বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
নতুন এ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারী সাক্ষরতার হার প্রায় ৪ শতাংশ কম। যেখানে পুরুষ সাক্ষরতা ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে নারী সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ১৫ থেকে ২৯ বয়সি যুব নারী-পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হারের ব্যবধান যৎসামান্য। এ বয়সি পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৯৫ শতাংশ এবং নারীদের ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। যুব সাক্ষরতার হার শহরাঞ্চলে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ, যার মধ্যে নারী ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও পুরুষ সাক্ষরতা ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে যুব সাক্ষরতার হার পুরুষদের ক্ষেত্রে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নারীদের ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সাক্ষরতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা সাধারণত তিনটি উপায়ে অর্জিত হয়। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় তারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতা লাভ করে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিরভাগ অক্ষরজ্ঞান শুরু হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য কেবল স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা এবং তা অবশ্যই গুণগত শিক্ষা।
তখনকার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টিই ছিলো চ্যালেঞ্জিং। আমাদের শুরু সেই অবস্থা থেকেই। বর্তমান অবস্থার সাথে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, আমরা আজ অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি। পরবর্তীতে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। এ অবস্থা উত্তোরণের পর ষাটের দশকের দিকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে হিসাব-নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই সাক্ষর হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে এসব দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষরতা শব্দটির সংজ্ঞায়নে পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিবর্তন যোগ হবে। নিরক্ষরদের সাক্ষরজ্ঞান প্রদান করতে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) নেয়া হয়েছিলো।
সারা বিশ্বে আজও বহু মানুষ শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি নিজের পরিচয়ও লিখতে পারে না অনেক মানুষ। বর্তমানে প্রাথমিকে শিশুদের রিডিং পড়তে পারার দক্ষতা অর্জনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যদিও শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। তাদের সাক্ষরতা দানের উদ্দেশে ইউনেসকো ৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেসকো উদ্যেগে ইরানের তেহরানে বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর ইউনেসকো দিবসটি প্রথম উদযাপন করে।
শিক্ষা, শিক্ষিত মানুষের হার বা সাক্ষরতার হার এসব বিষয় স্থির কোনো বিষয় নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ, প্রতিদিনই এই কার্যক্রম চলমান। তাই একেবারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোনো হিসাব বের করা জটিল কাজ। তবে পরিসংখ্যান যেহেতু সব কাজের তথ্য সংরক্ষণ করে সেহেতু হিসাব করা জরুরি। তা ছাড়া নিজেদের এই উন্নয়নের চিত্র যতোটুকু সম্ভব সঠিক হিসাব করতে হবে। কারণ, এই সাক্ষরতার হার উন্নত বিশ্বের মতো একদিন শতভাগের কাছাকাছি বা শতভাগ অর্জন সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর এর সঙ্গে যেহেতু দেশের অগ্রগতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেহেতু এটা অতি শিগগির অর্জন করা হবে। তাই সঠিক চিত্র আমাদের জানা প্রয়োজন। কোনো দেশের শিক্ষা বা সাক্ষরতার উন্নয়নে সেই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টিও জড়িত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের বাজেটের একটা বিরাট অংশ শিক্ষা খাতে নির্বাহ করে। সাক্ষরতা হচ্ছে শতভাগ শিক্ষিত করার প্রাথমিক ধাপ। সেজন্য ঝরে পরার হার শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। নিরক্ষতা, ক্ষুধা বা দারিদ্র্য হলো দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। এসব সমস্যাকে মোকাবিলা করতে পারে কেবল শিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়নে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সবার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। বিশ্বের মানচিত্রে একটি সুশিক্ষিত ও উন্নত জাতি হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে একজন সুনাগরিক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি নাগরিককেই সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। সাক্ষরতা শতভাগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। সেই শিক্ষা হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। বেকারত্ব লাঘবের উদ্দেশে শিক্ষা অর্জিত হতে হবে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা জরুরি। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক