দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ করছে ও বেঁধে দেয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্যাম্পাসে নির্মিত তাঁবু সরানোর বিষয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদেরকে বহিষ্কার করা শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কলেজ কর্তৃপক্ষ এর আগে সতর্ক করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সময় অনুযায়ী সোমবার দুপুর দুইটার মধ্যে তাঁবু ছেড়ে না গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাঝে পড়তে হবে বলে বিক্ষোভকারীদেরকে।
কিন্তু কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও কয়েক ডজন শিক্ষার্থী ওই স্থানে সমাবেশ করে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের অস্টিনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে চলমান আরেকটি বিক্ষোভ থেকে ডজনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন, যে বিক্ষোভকারীরা তাঁবু নামানোর নির্দেশনা উপেক্ষা করেছিল।
কলেজ কর্তৃপক্ষ বিবৃতিতে বলেছে যে বিক্ষোভকারীদের থাকার জায়গাগুলোতে "বেসবল-আকারের পাথর" পাওয়া গেছে এবং "অধিকাংশ বিক্ষোভকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত নয় বলে মনে করা হচ্ছে”।
বিক্ষোভকারীদের সাথে কাজ করছেন আইনজীবী জর্জ লব। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যম কেইউটি নিউজকে বলেছেন যে অস্টিন ক্যাম্পাসে সোমবার প্রায় ৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি।
চলতি মাসে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি ক্যাম্প উচ্ছেদ করার পর থেকে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে একই ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিউ ইয়র্কের সর্ব উত্তরের এই অভিজাত আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়- কলাম্বিয়ার কর্তৃপক্ষের ওপর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কিংবা সরে দাঁড়ানোর চাপ বাড়ছে।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন, “কলাম্বিয়ায় যা ঘটছে, তা সম্পূর্ণ অপমানজনক। ক্যাম্পাসটিতে এখন ইহুদীবিদ্বেষী ছাত্র ও শিক্ষক ছড়িয়ে পড়েছে।”
লুইসিয়ানার এই রিপাবলিকান আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট নেমাত শফিককে তার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন।
এর আগে সোমবার, হাউস ডেমোক্র্যাটদের একটি দল কলম্বিয়ার ট্রাস্টি বোর্ডকে “তাঁবুগুলো সরাতে ব্যর্থ হলে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে” পদত্যাগ করতে বলেছিলো।
“গত সপ্তাহ ধরে এই তাঁবুগুলো ইহুদি ছাত্রদের ওপর বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে” লিখেছেন ২১ জন আইনপ্রণেতা। “আলোচনার সময় শেষ, এখন পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।”
স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বছরে প্রায় ৯০ হাজার মার্কিন ডলার চার্জ করা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি।
নিউ ইয়র্কের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন গাজায় যুদ্ধ ও ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দেশটিতে চলমান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি, ইহুদী বিরোধিতার মাধ্যমে ইহুদী ছাত্রদেরকে বিপদের মাঝে ফেলার শঙ্কাও তৈরি করেছে।
দু’সপ্তাহ আগে, ১৮ই এপ্রিল ক্যাম্পাসের কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে নির্মিত একটি ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ১০০ জনেরও বেশি ছাত্রকে গ্রেফতার করেছিলো পুলিশ।
এই ঘটনার পর বিক্ষোভকারীরা আরও দ্বিগুণ উদ্যমে নতুন করে তাঁবু খাটাতে শুরু করে।
সপ্তাহের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়টি “ক্যাম্পাসে আসন্ন লকডাউন বা উচ্ছেদের” গুজবকে অস্বীকার করেছে এবং শিক্ষার্থীদেরকে বলেছে যে এখন পুলিশ ডাকার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
সোমবার সকালে ড. শফিক একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “এসব ক্যাম্প সরানোর একটি উপায় খুঁজে বের করার জন্য বুধবার থেকে একাডেমিক প্রধানদের একটি ছোট দল ছাত্র সংগঠকদের সাথে আলাপ করছে।”
“দুঃখজনকভাবে, আমরা কোনো সমঝোতায় আসতে পারিনি,” তিনি বলেন।
সংগঠকদেরকে একটি চিঠির মাধ্যমে সতর্ক করেছে কর্তৃপক্ষ, “বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে আমাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
ছাত্রদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো যে তারা যদি স্থানীয় সময় দুপুর দুইটার মধ্যে স্বেচ্ছায় আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়, তবে তাদেরকে সেমিস্টার শেষ করার অনুমতি দেওয়া হবে।
সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জানান, যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদেরকে সাসপেন্ড করা শুরু করেছে ও সাময়িকভাবে তাদেরকে ক্যাম্পাস থেকে নিষিদ্ধ করেছে। যাদের স্নাতক শেষ করার বিষয়টি নির্ধারিত ছিল, তারা এখন আর তার জন্য যোগ্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, আগামী ১৫ই মে গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য আংশিকভাবে তাদের প্রতি সাসপেনশেন বা স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারী দলগুলোর মাঝে অন্যতম প্রধান হলো কলম্বিয়া স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন, যারা এক্স-এর একটি পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ অমান্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বিক্ষোভকারীদেরকে "ক্যাম্প রক্ষা" করার আহ্বান জানিয়েছে।
বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর মর্নিংসাইড ক্যাম্পাসে কিছু তাঁবু রয়ে গেছে। ছাত্র সমর্থকরা সেটির চারপাশে মিছিল করেছে, কেউ কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে এবং স্লোগান দিচ্ছে: "বিপ্লব!"
চলমান ইস্যুতে কলাম্বিয়া কর্মকর্তাদের সাথে যেসব ছাত্র আলোচনা করেছেন, তাদের একজন হলেন মাহমুদ খলিল। তিনি বলেছেন, যে বিক্ষোভকারীরা বিশ্বাস করে যে তাঁবু সরানোর জন্য আবারও পুলিশ ডাকার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
"ছাত্ররা এখানে আছে," মি. খলিল যোগ করেন এবং বলেন যে তিনি একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী ছিলেন, যিনি সিরিয়ায় বেড়ে উঠেছেন। "তারা তাদের জায়গা ধরে রেখেছে।"
অনেকেই মুখ ঢেকে রেখেছিলেন ও বলেছেন যে তারা চিহ্নিত হওয়ার ও অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়ে চিন্তিত।
বিশ্ববিদ্যালয় সোমবার তার চিঠিতেও লিখেছে যে তারা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণকারীকে চিহ্নিত করেছে।
ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে কমলা এবং হলুদ ভেস্ট পরে শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে মানবন্ধনে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু কর্মকর্তা ও শিক্ষক।
ইতোমধ্যে পুলিশকেও ক্যাম্পাসে ব্যারিকেড দিতে দেখা গেছে এবং তারা সেখানে স্ট্যান্ডবাই রয়েছে। যদিও তারা কাউকে গ্রেফতার বা উচ্ছেদের কোনো চেষ্টা করেনি।
কলাম্বিয়ার প্রশাসকরা কীভাবে এ বিষয়টি সামাল দেবেন তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে কারণ এই বিক্ষোভ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসি ও কমপক্ষে আরও ২২টি প্রদেশের ক্যাম্পাসের খোঁজ নিয়েছে বিবিসি।
ভার্জিনিয়া টেকের পুলিশ রোববার রাতে ৯১ জনকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে, যার মধ্যে বর্তমানে কলেজে অধ্যয়ত ৫৪ জন রয়েছে৷
সোমবার জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও গ্রেপ্তার করা হয়। নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতেও সোমবার এক বিবৃতিতে "তাৎক্ষণিক অস্থায়ী স্থগিতের" আদেশ দেওয়া হয়েছিলো।
লস এঞ্জেলসের (ইউসিএলএ) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ায় উত্তেজনা চরমে উঠেছে।
কয়েক মাস ধরে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা এখন দাবি করছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন ইসরায়েলের আর্থিক সাহায্য বর্জন করে।
সোমবার ডা. শফিক বলেছেন যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপায় বের করার চেষ্টা করছে, তবে “ইসরায়েলকে বর্জন করবে না”।
একই সময়ে, কিছু অংশগ্রহণকারীদের ঘৃণামূলক বক্তব্য, হয়রানি এবং সহিংসতার হুমকির অভিযোগের কারণে ইহুদি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
নিউ ইয়র্কের রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান এলিস স্টেফানিক বলেন, “ইহুদি শিক্ষার্থীদের প্রতি অবহেলা বিশ্ব দেখছে।” তিনি কলাম্বিয়ার ব্যাপারে “ফাঁকা হুমকি ও দুর্বল নেতৃত্বের” অভিযোগও করেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ অন্যান্য রিপাবলিকানরাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ইহুদি বিরোধী শ্লোগান এবং ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন।
“এটি একটি বেদনাদায়ক মুহূর্ত। আমরা এটি পেয়েছি,” প্রেস সচিব কারিন জিন-পিয়েরে বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব কীভাবে কাজ করবে তা বলতে অস্বীকার করে তিনি যোগ করেছেন: “আইনের মধ্যে থেকেই স্বাধীন মত প্রকাশ করতে হবে।"
সূত্র : বিবিসি