সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি বঞ্চিত অগণিত হাজারো শিক্ষক। বিশেষ করে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় সিনিয়র শিক্ষকেরা একই পদে অবসরে গেছেন। আবার কেউ কেউ কবরেও চলে গেছেন। দুয়েক বছর পর পর প্রাথমিকের মন্ত্রণালয় সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকা করে গোপন প্রতিবেদন দাখিল করার জোর তাগিদ দেয়া হয়।
কিছু সময়ের পর পদোন্নতির কার্যক্রম বিদ্যুতের ঝলকানির মতো থেমে যায়। সচিব সাহেব দুই মাস আগে মিডিয়ার মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দ্রুত প্রাথমিকের সহকারীদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। প্রায় একমাস হতে চলল পুনরায় তালিকা তৈরি নির্দেশনা দেয়া হলো। সচিব মহোদয়ের অবসর গ্রহণের সময় অতি সন্নিকটে।
তিনি হয়তো বলবেন, ‘আমার যাওয়ার সময় হলো দাও বিদায়’। তিনি তো পদোন্নতি পেতে পেতে সচিব হয়েছেন। ইদানিং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত তাদের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হবে। জানি না প্রাথমিকের সচিব পদোন্নতি বঞ্চিত কি না? তাহলে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনিও সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যাবেন।
অবসরের পূর্বে সকলের প্রত্যাশা বিদায়কালীন কর্মদিনগুলো যেনো সম্মানের, আনন্দের ও স্বস্তিদায়ক হয়। প্রাথমিক শিক্ষকেরা ছাড়া তৃণমূল কর্মকর্তারাও পদোন্নতি বঞ্চিত। যোগ্যতাসম্পন্ন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কম গুরুত্ব দিয়ে সাবেক সরকারের আমলের বর্তমান সচিব সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এর নিয়োগবিধি ২০২৩ আইন পাস হয়। সে নিয়োগ বিধিতে অনাভিজ্ঞদের সরাসরি নিয়োগের বিষয়কে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক, পিটিআইয়ের শিক্ষক, ইন্সট্রাক্টর, কর্মকর্তাদের পদোন্নতির দ্বাররুদ্ধ করে বঞ্চিত করা হয়েছে। প্রাথমিকের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে খুবই কম সংখ্যক দক্ষ কর্মকর্তা উপ-পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। তারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করবার সুযোগ পাচ্ছে না। অন্য মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ শিশু শিক্ষায় অনাভিজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার নীতিনির্ধারনী কাজ। যার ফলে হোঁচট খেয়ে নিম্নমুখী হতে যাচ্ছে শিশু শিক্ষার ভবিষ্যৎ। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিকের শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি অনুধাবন করে ব্যবস্থা নেবেন। মেধাবী অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল প্রাথমিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করবে। দুইজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা তৃণমূল থেকে শিশুশিক্ষায় প্রশিক্ষণে, অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নিয়ে এ মাসের ১ম সপ্তাহে অবসরে যাবেন।
অবসরগামী কর্মকর্তারা হলেন-ড. তাহমিনা বেগম ও মহিউদ্দিন তালুকদার। এ রকম তৃণমূল থেকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ দেয়া হলে প্রাথমিক শিক্ষা হয়ে উঠবে সমৃদ্ধ। অনুরূপভাবে প্রাথমিকেও অসংখ্য দক্ষ, উচ্চ শিক্ষিত, মাস্টারট্রেইনার দীর্ঘ সময় থেকে শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। তারাও পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে আজ অবসরে যাচ্ছেন।
যেহেতু সরকারি বিধি অনুযায়ী তাদের শিক্ষকতা করার সুযোগ নেই। প্রাথমিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে খণ্ডকালীন ট্রেইনার হিসেবে নিয়োজিত করলে প্রাথমিক শিক্ষকেরা হয়ে উঠবে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের সমৃদ্ধ ভান্ডার। অসংখ্য গুণী শিক্ষকদের মাঝে ঢাকা শহরে মতিঝিল থানার এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কাজী ফাহিমা আক্তার অন্যতম। তিনি মাস্টার্স, অসংখ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অভিজ্ঞ মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে ইউআরসিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েও ৩৮ বছর শিক্ষকতা করে প্রধান শিক্ষক হিসাবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। শিক্ষক কর্মকর্তা যারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের সবাইকে সাধ্যমত পুরস্কৃত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবিনয় নিবেদন করছি। কেবলমাত্র সচিবদের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হলে বৈষম্য দূরীকরণের প্রত্যয়ে নিয়ে গঠিত সরকার মাঝে তৈরি হবে বিশাল বৈষম্য। জরুরি ভিত্তিতে সরকারি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি ১০ম গ্রেড, যা সহকারী শিক্ষকদের থার্ড ক্লাসে মর্যাদা থেকে সেকেন্ড ক্লাস মর্যাদা পাওয়ার অধিকার। এ ছাড়াও সহকারী শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যৌক্তিক প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: শিক্ষাবিদ