বদলি এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার - দৈনিকশিক্ষা

বদলি এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার

সাধন সরকার |

শিক্ষা বিভাগের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৮৪টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন প্রায় ১৩ হাজার। অপরদিকে, মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩১ হাজারের বেশি। সে হিসাবে সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখের কাছাকাছি (কর্মচারী বাদে)। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো এমপিওভুক্ত নয়। নন-এমপিও এসব শিক্ষকের সংখ্যা বাদ দিলে মোটাদাগে বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৪ শতাংশ শিক্ষক সরকারি এবং ৯০ শতাংশ শিক্ষক এমপিওভুক্ত। মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই ৯০ ভাগ শিক্ষক সরকারের নিয়ন্ত্রণে।

এখন এনটিআরসিএ থেকে (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) সরকারি সিদ্ধান্তে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। গত চারটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিভিন্ন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি) এক লাখেরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘এসএমসি’র (স্কুল ম্যানেজিং কমিটি) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বলতে গেলে সবই দিচ্ছে সরকার। যেমন-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের মূল বেতন, আংশিক সুবিধা ও ভাতা ইত্যাদি। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পার্থক্য হলো এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি পান না। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক কয়েকগুণ বেশি বেতন দিয়ে পড়তে হয়। এ ছাড়া শিক্ষকদের বাড়িভাড়া যৎসামান্য। 

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কোনো বদলি নেই। মূল যে বিষয়, তাহলো মানসম্মত লেখাপড়া ও ভালো ফলাফলের দিক দিয়ে আদতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো ফারাক নেই। বরং হাতেগোনা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এমপিওভুক্ত হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল অনেক ভালো। সরকারি শিক্ষক ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোনো ফারাক নেই। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি অনেকটা জাতীয়করণের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্য যে বিষয়টি তা হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির বিষয়। যদিও সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ‘পারস্পরিক বদলি নীতিমালা-২০২৪’ (শুধুমাত্র এনটিআরসি থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য) প্রকাশ করা হয়েছে। নীতিমালা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন এটিকে প্রত্যাখান করেছে। শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো শূন্যপদের ভিত্তিতে বদলি। কিন্তু সেটা না করে কর্তৃপক্ষের এহেন সিদ্ধান্তে শিক্ষকরা হতাশ হয়েছেন। পাশাপাশি শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন শূন্যপদের ভিত্তিতে বদলি নীতিমালার দাবি জানিয়েছেন। কেনোনা পারস্পরিক বদলি জটিল প্রক্রিয়া এবং এক প্রকার অসম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় এনটিআরসিএ থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত ১ ভাগ শিক্ষকও বদলি হতে পারবেন না।

‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির দাবিটি দীর্ঘদিনের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনেকবার আশ্বাস দেয়া হলেও বহুল আকাঙ্ক্ষিত বদলি কার্যক্রম প্রক্রিয়া কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সব তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। বদলি কার্যক্রম চালুর জন্য শুধু সদিচ্ছা ও আন্তরিক উদ্যোগই যথেষ্ট। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শূন্যপদের ভিত্তিতে বদলির বিষয়ে নীতিমালার খসড়া হয়েছিলো বলে জানা যায়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন চলতি বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বদলি নিষ্পত্তি করা হবে। কার্যক্রম ঠিকঠাকভাবে এগোচ্ছে দেখে শিক্ষকেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। বদলি কার্যক্রমের সফটওয়্যারও প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছিলো। এ খবরে বদলিপ্রত্যাশী হাজার হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষক বহুদিন পর আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু এদেশে যতোক্ষণ না কোনো কিছু বাস্তবায়ন হয় ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো আশ্বাস বা নীতিমালা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনো সুযোগ নেই।

অজানা কারণে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রেও হলো তাই! জানি না ঠিক কী কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এমপিও শিক্ষকদের জানিয়ে দেয়া হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। অথচ অতি সম্প্রতি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষকের মাত্র ৪ ভাগ) শিক্ষকদের জন্য (বছরে দুই দফায়) বদলির নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে সেখানে শিক্ষকদের জন্য ন্যূনতম বদলি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা কী গুরুত্বপূর্ণ নয়? ৯০ ভাগ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার কী কোনো মূল্য নেই? হোক বেসরকারি, তাই বলে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

পরিমাণ ও গুণগত বিচারে দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে সবচেয়ে বেশি অবদান বেসরকারি শিক্ষকদের। তাহলে সেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা কেনো বদলির সুযোগ পাবেন না? সরকারি সব বিদ্যালয়ের মতো ৩১ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের সব নির্দেশনা ও কার্যক্রম মেনে কাজ করে যাচ্ছে। অন্য সব চাকরিতে বদলি থাকলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা কেনো বদলির সুযোগ পাবেন না? প্রশ্ন হলো, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বছরে দুই দফায় বদলির ব্যবস্থা করা হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা বছরে একবার সে সুযোগ কী পেতে পারেন না? এটা ছোটখাটো কোনো বৈষম্য নয়! এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুবই সামান্য। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক পরিবার নিয়ে নিজ উপজেলা-জেলার বাইরে গিয়ে কীভাবে সামান্য বেতনে (শুরুতে স্কুল পর্যায়ে প্রায় ১৩ হাজার, কলেজ পর্যায়ে প্রায় ২২ হাজার) সংসার চালাবেন-এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনো ভেবেছে কি? নিজ এলাকা রেখে অন্য এলাকায় গিয়ে চাকরি করতে গিয়ে শিক্ষকের মাত্রাতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। বেতনের পুরোটা খরচ করার পরও শিক্ষককে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। শত শত কিলোমিটার দূরে চাকরি হওয়ায় সামান্য বেতনের এমপিওভুক্ত হাজার হাজার শিক্ষক বেদনাভরা মন নিয়ে নিজের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এনটিআরসি থেকে সুপারিশ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকের পরিবার মূলত দুটো-একটি তার নিজের চাকরিস্থল, অন্যটি গ্রামের বাবা-মায়ের পরিবার। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে দুটো পরিবারের খরচ চালানো মোটেও স্বস্তির বিষয় নয়। বদলি জটিলতা দূর হলে শিক্ষকেরা নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সংশ্লিষ্ট কাজে আরো বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে পারবেন বলে মনে করি।

প্রায় চার লাখ শিক্ষকদের অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষক পরিবার। যারা শিক্ষকতা পেশায় নিজের সেরাটা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বদলি কার্যক্রম না থাকাতে অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বদলি হতে না পেরে শিক্ষকের আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। অনেক শিক্ষক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। বদলি না থাকায় মেধাবীরা এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে অনীহা প্রকাশ করছেন। ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১’-এর ১২.২ ধারায়ও বদলির নীতিমালা প্রণয়নের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই পারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে বদলির ব্যবস্থা চালু করতে। বদলির সুযোগ একজন চাকরিজীবীর অধিকার। বদলির মতো ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার শিক্ষকদের অবশ্যই আছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বছরে দুই দফায় বদলির সুযোগ পেলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা একবার হলেও সে সুযোগ পাওয়ার দাবিদার। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ের দাবি মেনে নিতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।  

লেখক: শিক্ষক

এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে ডিসি ও ইউএনও - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে ডিসি ও ইউএনও ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি: নিয়োগ পাচ্ছেন ১৯ হাজার ৫৮৬ শিক্ষক - dainik shiksha ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি: নিয়োগ পাচ্ছেন ১৯ হাজার ৫৮৬ শিক্ষক এইচএসসির অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিল, ফল কীভাবে পরে সিদ্ধান্ত - dainik shiksha এইচএসসির অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিল, ফল কীভাবে পরে সিদ্ধান্ত প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পরিবর্তন - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পরিবর্তন দীপু মনি ‘চোর’, ফাঁসি চাই, এজলাসে আইনজীবীদের চিৎকার - dainik shiksha দীপু মনি ‘চোর’, ফাঁসি চাই, এজলাসে আইনজীবীদের চিৎকার ইবতেদায়ি শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘট - dainik shiksha ইবতেদায়ি শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘট সম্মানীর টাকা নিয়ে প্রতারণা: ফেলোদের সতর্ক থাকার পরামর্শ ইউজিসি’র - dainik shiksha সম্মানীর টাকা নিয়ে প্রতারণা: ফেলোদের সতর্ক থাকার পরামর্শ ইউজিসি’র কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038900375366211