ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে অপেক্ষা করছিলেন রাজবাড়ীর বাসিন্দা মামুন কবির। ছেলে পারভেজ (১৬) শনির আখড়া থেকে আটক হয় গত শনিবার। মামুন কবির তার ছেলে আটক হওয়ার খবর পেয়েছেন আদালত থেকে। এরপর আর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি। কারাগারে এসেছেন ছেলের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সে সুযোগও নেই। গত কয়েক দিন কারাগারে আসামিদের সঙ্গে স্বজনের সাক্ষাৎ পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
মামুন কবির বলেন, ‘আমার ছেলে কাঠমিস্ত্রি। শনিবার ফার্নিচারের দোকানে কাজ করার সময় বাইরে থেকে নাশতা কিনতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়। এর পর থেকে তার সঙ্গে আর কথা বলার সুযোগ পাইনি। কারাগারেও দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। এখন ছেলের সঙ্গে দেখা না করেই রাজবাড়ী ফিরে যেতে হবে।’
পেশায় ভ্যানচালক খোকন গাজী আটক হয়েছিলেন রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে। তার হার্টে দুটি ব্লক আছে। তার জন্য প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে অপেক্ষা করছিলেন তার ৪৮ বছর বয়সী স্ত্রী। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগই পাচ্ছিলেন না তিনি। বারবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘অন্তত কিছু কিনে খাওয়ার জন্য যদি টাকা দিতে পারতাম!’
নরসিংদীর কারাগার থেকে গত শুক্রবার পালিয়ে যায় আট শতাধিক বন্দি। চালানো হয় ব্যাপক ভাংচুর। এ ঘটনার পর সারা দেশের সব জেলখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এর অংশ হিসেবে জরুরি পরিস্থিতিতে কারাগারে আত্মীয়-স্বজনের সব ধরনের সাক্ষাৎ সাময়িক বন্ধ রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে জোরদার করা হয়েছে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কারারক্ষীদের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে র্যাব, পুলিশ ও আনসারের অতিরিক্ত সদস্য।
বর্তমানে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে কারা ফটক থেকেই ফেরত যেতে হচ্ছে স্বজনকে। অনেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও জামাকাপড় নিয়ে এসেও দেখা করতে পারেননি বন্দি স্বজনের সঙ্গে। তাই অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। বাছবিচারহীন গণগ্রেফতারেরও অভিযোগ তুলছেন স্বজনরা।
হৃদরোগে ভুগছেন কামরাঙ্গীর চর থেকে আটক হওয়া স্থানীয় আল-আমীন মসজিদের ইমাম আবদুর রহমান। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কারা ফটকের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন স্ত্রী ও ছেলে রানা। ইমাম আব্দুর রহমানের ছেলে জানান, সোমবার মসজিদ থেকে নামাজ শেষে বের হওয়ার পর আবদুর রহমানসহ সাতজনকে একসঙ্গে গ্রেফতার করা হয়।
কারা ফটকেই সেলফোনে কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন নারায়ণগঞ্জের জাহানারা বেগম। স্বামী অটোমোবাইল পার্টসের মিস্ত্রি জাফরের জন্য জামাকাপড় আর টুথপেস্ট নিয়ে এসেছিলেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে না জেনেও অপেক্ষা করছেন। বাসায় যাবেন না বলে স্বজনকে ফোনে জানাচ্ছিলেন।
জাহানারা বলেন, ‘বাসায় আমার ছোট ছেলেটা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাই ওকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি। কারাগারের সামনে দাঁড়াতেও দিচ্ছে না। আমাদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে।’
কামরাঙ্গীর চর থেকে আসা কারাগারের সামনে অপেক্ষায় আছে সাত বছরের মেয়ে রৌজা। মায়ের সঙ্গে এসেছে বাবার জন্য কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু সাক্ষাৎ হয়নি। রৌজার মা জানান, তার স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন মুদি দোকানি। স্বামী আটকের খবর শুনে থানায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানেও সাক্ষাৎ হয়নি। কাপড় নিয়ে এসেছিলেন কারাগারে। তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার। গরমের মধ্যে তিন-চারদিন ধরে এক কাপড়ে রয়েছেন তার স্বামী।
এভাবে কারাবন্দিদের সঙ্গে তাদের স্বজনকে দেখা করতে না দেয়া বা প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ও ওষুধ দিতে না দেয়াকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারকর্মীরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘কোনো সভ্য দেশে এমনটা হতে পারে না। দেশে যা চলছে, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আটককৃত মানুষের সম্মান ও সুরক্ষা রক্ষা করা আটককারীদের দায়িত্ব।’
ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে সব ধরনের প্রবেশ বন্ধ রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের আশপাশের সব চায়ের অস্থায়ী দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এখন এসব অস্থায়ী স্থাপনাও সরিয়ে নিতে হচ্ছে।
কারাগারটি চালুর পর থেকেই এখানে চা-বিড়ি বিক্রি করছেন কাইয়ুম মিয়া। নিজের দোকান ও পণ্য সরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। জানতে চাইলে এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দোকান সরিয়ে নিচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখতে বলেছেন জেল সুপার। আর দোকানের পণ্য ও স্থাপনাও সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
কারাগারে সাক্ষাৎ বন্ধ থাকাসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি) প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হক বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেখা-সাক্ষাৎ আবার চালু করা হবে। আর স্বজনেরা কাপড় বা ওষুধ নিয়ে এলে তা আমরা বন্দিদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকি। অনেকেই অপ্রচলিত ধরনের ওষুধ গ্রহণ করে। এসব ওষুধ বাইরে থেকে স্বজনরা দিয়ে যায়। তবে এখন এসব দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমরা কারাগারগুলোয় বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেব।’
টানা কয়েক দিনের সংঘাত-সংঘর্ষ ও সর্বশেষ ঘোষিত কারফিউর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায়। প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে পণ্যবাহী ট্রাকের চলাচল। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে অচলাবস্থা। এতে জনসাধারণের পাশাপাশি কারাগারের বিপুলসংখ্যক বন্দিরও খাদ্য সরবরাহে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে এখন কয়েদি ও হাজতি মিলিয়ে বন্দি রয়েছে ৬৩ হাজারের বেশি। তাদের দৈনন্দিন খোরাক নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠছে। দু-একদিনের মধ্যে পণ্য পরিবহন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সরবরাহ জটিলতা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবহন খাতের নেতারা জানান. ‘তীব্র আন্দোলনের মধ্যে পরিবহন শ্রমিক ও গাড়ির নিরাপত্তা না থাকায় পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রমিকের নিরাপত্তা নেই, গাড়ির নিরাপত্তা নেই। তাহলে কে গাড়ি চালাতে যাবে? তাই এখন পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। আমরা আরো দু-একদিন পরিস্থিতি দেখব। তারপর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ হাজার বন্দি রাখার ধারণক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কারাগারটিতে এখন বন্দি আছে আট হাজারের বেশি। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত এসব বন্দিকে তিনবেলা খাবারের জোগান দিতে হয়। এজন্য প্রতিদিন বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ সামলাতে হয় তাদের। চাল-ডাল ও আটার মতো শুকনা খাবারের মজুদ থাকলেও প্রতিদিনের মাছ-মাংস ও সবজি প্রতিদিনই কিনতে হয়। চলমান স্থবিরতায় এ নিয়ে বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাসির উদ্দীন বলেন, ‘শুকনা খাবারের দু-এক মাসের মজুদ থাকে আমাদের কাছে। তবে মাছ-মাংস ও সবজি প্রতিদিন কিনতে হয়। এসব জোগাড় করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। তবে সরবরাহ পাচ্ছি এখনো। আর জরুরি পরিস্থিতিতে সাক্ষাৎ বন্ধ থাকায় স্বজনকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’