২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। এ কাজের মূল দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ওপর। কিন্তু গত জুলাই থেকে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ নেই, নতুন কোনো কর্মসূচিরও খবর নেই। ফলে বলতে গেলে বসে বসে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির ২৫১ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে, অবাক করা বিষয় হলো আরও ৭০৭ জনবল নিয়োগ করা হবে এখানে। এতে তাদের জন্য মাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে সোয়া কোটি টাকা।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিস্তারিত পড়ুন : উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পুরনো অর্গানোগ্রামে পদের সংখ্যা ৩৭৮। প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তার পদ ১৭টি। ব্যুরোর অধীনে ৬৪টি জেলা কার্যালয় রয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ পদ সহকারী পরিচালক। সেসব কার্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৯২ জন। তবে ৩৪ জেলাতেই সহকারী পরিচালকের পদ শূন্য। অবসরে চলে যাওয়ায় কর্মচারীদের অনেক পদই শূন্য।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা সাধারণত প্রকল্প বা কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষরতা বাড়ানোর কাজ করে থাকি। এসবের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের কাজ করেন আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সর্বশেষ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতার প্রকলল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও তা এ বছরের জুনে শেষ করে দেওয়া হয়। আমরা যেসব পরিকল্পনা ও প্রস্তাব দিয়েছিলাম তার কোনোটিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই। এখন সরকারি দপ্তর হিসেবে আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করি। এভাবে চললে এ দপ্তরে ডিজিরও প্রয়োজন থাকবে না।’
রাজধানীর মহাখালীতে ব্যুরোর প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সুনসান নীরবতা। অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস এলেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কথা মনে পড়ে। দিবসটি বাবদ প্রায় ৫০ লাখ টাকার বাজেট থাকে। এ বছরও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দিবস উদযাপনে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ টাকা। অন্য সময়ে মন্ত্রণালয়ও ব্যুরোর কথা ভাবে না। অথচ এর মূল কাজ দেশের সাক্ষরতার হার বাড়ানো।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে নৈশ বিদ্যালয়ে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রথম চালু হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বিলুপ্ত করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো করা হয়। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি তাদের জন্য কাজ, শিক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করাই এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর বর্তমান রুগ্্ণ দশা। মন্ত্রণালয়ের আগের দুই সচিব এ দপ্তরকে চরম অবহেলা করেছেন। মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ব্যুরোর বিভিন্ন প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। ফলে দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে না।
মন্ত্রণালয় চাইছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে পাশ কাটিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে গণশিক্ষার কার্যক্রম চালাতে। ফলে বিপুলসংখ্যক জনবলকে বসে বসে দিন পার করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর জেলাপর্যায়ের একজন সহকারী পরিচালক বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি থাকত আগে, সেগুলোর মনিটরিং আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল। এখন মাঠপর্যায়ে কোনো কাজ নেই। কোনো সার্ভে নেই। কোনো প্রকল্প নেই। আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেই। বিশেষ করে এনজিওদের প্রোগ্রামে গিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদেরও এ ধরনের কাজের জন্য ফান্ড নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৭৪ দশমিক ৭ ও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দেও সাক্ষরতার হার একই বলে জানানো হয়েছে। ২০২২ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
জানা যায়, সাক্ষরতার হার বাড়ানোর মূল দায়িত্ব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর। তাদের একমাত্র প্রকল্প ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা)’-এর মেয়াদ ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত হলেও অজ্ঞাত কারণে তা শেষ করে দেওয়া হয় এ বছরের জুনে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫-এর আওতায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বিদ্যালয়বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পিইডিপি-৩ থেকে আগত এক লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৯ লাখের প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২৫ হাজার ৭১২টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের পাঠদান করা হচ্ছে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অর্গানোগ্রামের আকার বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়েও ব্যুরোর অফিস খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একজন কর্মকর্তা, একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও একজন অফিস সহায়কের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপজেলা কর্মকর্তা নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের কাছে চাহিদার কথা জানানো হলেও তা ঝুলে আছে। গত জুনে ২৬৫ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও ৪৪২ জন অফিস সহায়ক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তা স্থগিত রয়েছে।