বাংলা ভাষাতেই ছিলো স্বাধীনতার বীজ - দৈনিকশিক্ষা

বাংলা ভাষাতেই ছিলো স্বাধীনতার বীজ

প্রশান্ত কুমার কর্মকার |

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ব্রিটিশরা। পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জম্ম নেয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ধর্মে মিল থাকলেও সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত কোনো মিলই ছিলো না। দেশ বিভাগের পর এই সত্য অনুভব করেন পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে র্উদুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব বাংলাকে ইসলামিকরণ করার প্রস্তাব করা হয়। এর ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিলো। জাতিগত তথ্যে পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে শোষণ-তোষণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের তরুণ টগবগে ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেবেন, তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা কল্পনাও করেননি। অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী এবং মৌলভী আবদুল হকদের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে র্উদুভাষা বিস্তার লাভ করে। উর্দুকে ইসলামি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আর হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দু ধর্মের ভাষা বিবেচনা করা হতো। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগ লক্ষ্মৌ অধিবেশনে উর্দুকে মুসলিমদের ভাষা হিসেবে মনোনয়নের প্রস্তাব করলে বাংলার সভ্যরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। 

এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুহম্মদ এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনুমোদিত তালিকা ও মুদ্রা এবং ডাকটিকিট থেকেও বাংলা বিলুপ্ত করা হয়। ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র সমাবেশ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রথমে তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া, এরপর সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। কিন্তু তার দাবি সেদিন অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত পুনর্গঠিত করা হয়। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেয়া হয়। পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেন। 

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবি তোলেন এবং সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। তাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বাগত জানান। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন র্উদুভাষার পক্ষে কথা বলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে’। কিন্তু সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে অনেক বাঙালি মুসলমান সদস্য সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত সংশোধনীকে সমর্থন করেননি। গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারিও ধর্মঘট ঘোষিত হয় এবং ওইদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশ থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং শামসুল আলম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ পরিষদ থেকে ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়।

১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রদের একটি দল রমনা ডাকঘরে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। আরেকটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। তারা গণপরিষদ ভবন (জগন্নাথ হলের মিলনায়তন), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বর্তমান বাংলা একাডেমি), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভ দমনের জন্য কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে নিয়ে যান। পুলিশ প্রতিবাদ সভা থেকে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, মো. নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। সেদিন সভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দিন আহমদ। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে গ্রেফতার হওয়া বন্দিদের মুক্তি, পুলিশি নির্যাতন-অত্যাচারের তদন্ত, বাংলাভাষা শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা, সংবাদপত্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিলো জিন্নাহর প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। এক ভাষণে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন যে, ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন,  ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাষা আন্দোলনকারীদের পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন। পরদিন ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও একই ধরনের বক্তব্য দেন জিন্নাহ। ওইদিনই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। জিন্নাহ সেইদিন খাজা নাজিমুদ্দিনের সমঝোতা চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন। ২৮ মার্চ জিন্নাহ; ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দিন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তমুদ্দিন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহর কাছে হস্তান্তর করে। তমুদ্দিন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে আন্দোলনের পথ থেকে সরে দাড়ান। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। এর আগে ১৭ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাতে সাড়া দেননি। এর কিছুদিন পরই, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়, এবং এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। এ কমিটি প্রতিবেদন তৈরি করে; কিন্তু তা ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করা হয়েছিলো। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কথা পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। 

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আমতলায় সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে সভায় স্যার সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত ফজলুল হক মুসলিম হলের নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল গেট আমতলায় ছাত্ররা জড়ো হন। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী এদিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানান। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওই সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার শুরু করলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ৩টার দিকে ছাত্ররা আইনসভার দিকে রওনা করলে পুলিশ গুলি করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরো অনেকে নিহত হন। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান। গণপরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের লক্ষ্যে অধিবেশন স্থগিত রাখতে বলেন। তা উপেক্ষা করে নুরুল আমিন অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের হয় এবং সারা দেশ মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করে, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ছেড়ে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু হয়। ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহ্বান করে এবং সরকারের কাছে ২১-দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের উদ্দেশে প্রভাতফেরিতে নগ্ন পায়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যেন আন্দোলনের আর কোনো সুযোগ না পায় সেজন্য মুসলিম লীগ তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এরপরও আইয়ুব খানের প্রতিষ্ঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলো। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে স্বাধীনতার ডাক। 

লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040650367736816