বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে ভ্রমণসহ বিভিন্ন খরচ কার্ডের মাধ্যমে টাকা-রুপিতে করার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য শিগগির রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী এবং বেসরকারি খাতের যেসব ব্যাংক কার্ড ব্যবসায় এগিয়ে আছে, তাদের নিয়ে একটি বৈঠক হবে। সেখানে কার্ড চালুর পদ্ধতি, লেনদেনের ঝুঁকি এবং লাভ-ক্ষতির বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হবে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জান যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওবায়দুল্লাহ রনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিকভাবে নিজেদের মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বেশ আগ থেকে চেষ্টা করে আসছে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েকটি বড় দেশ। আর এ জন্য ওই দেশগুলো পার্শ্ববর্তী দেশে নিজেদের মুদ্রা প্রচলনের বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। তবে বৈশ্বিকভাবে ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা কম থাকায় ব্যবসায়ীদের তাতে সাড়া নেই। ২০১৮ সালে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টের অনুমোদনের পর গত সেপ্টেম্বরে আবার এলসি খোলারও সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতেও সাড়া নেই। আর ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরের পর থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুই দেশের বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে আজও তা কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা-রুপির লেনদেনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে গত ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত জি-২০ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের বৈঠকের পর। ওই সময় বাংলাদেশ ও ভারতের গভর্নরের মধ্যকার বৈঠকে ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন নিয়ে কথা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করে এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক নতুনভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, টাকা-রুপিতে লেনদেনের সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক নিয়ে এখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, টাকা-রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তি অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ। চিকিৎসা, ভ্রমণ, শিক্ষা, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশি ভারতে যান। ভারত থেকেও অনেকে বাংলাদেশে আসেন। প্রাথমিকভাবে এই লেনদেন নিজস্ব মুদ্রায় করার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
বিদ্যমান নিয়মে ব্যাংকগুলো শুধু ডলার ও ইউরোতে আন্তর্জাতিক কার্ড ইস্যু করে। ভিসা, মাস্টারকার্ডের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই এসব লেনদেন নিষ্পত্তি হয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক এসব কার্ড নিয়ে ভারতে গিয়ে চাইলে রুপিতে পরিশোধ করা যায়। এটিএম বুথ থেকেও তোলা যায় নগদ রুপি। তবে এ জন্য টাকা থেকে ডলার, সেখান থেকে রুপিতে রূপান্তরের ফলে বিনিময়জনিত লোকসান হয়। নতুনভাবে সরাসরি রুপিতে কার্ড ইস্যুর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। তবে ভিসা, মাস্টারকার্ড প্ল্যাটফর্মের বাইরে সরাসরি টাকা-রুপিতে লেনদেন নিষ্পত্তি করতে হলে এক দেশ আরেক দেশের লেনদেন নিষ্পত্তির নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে এক্সেস দিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে এরকম ব্যবস্থায় রাজি হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন, বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে দুই দেশের মুদ্রা চালুর বিষয়টি আরও জটিল। কেননা, কারেন্সি সোয়াপ তথা নিজস্ব মুদ্রার অদল-বদল পদ্ধতিতে কিংবা মুদ্রার অবাধ লেনদেন– যে পদ্ধতিতেই হোক, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। কেননা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ফলে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তি করতে চাইলে তখন ডলার দিয়েই বাংলাদেশকে ভারতীয় রুপি কিনতে হবে। না হলে অতিরিক্ত অর্থ বাংলাদেশের বিল, বন্ড বা অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। ফলে আদতে বাংলাদেশে ডলারের ওপর চাপ কমবে না। মুদ্রা অবাধ হলে যে কোনো কেনাকাটায় তখন রুপি দেওয়া যাবে। পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় মুদ্রা বাংলাদেশে অবাধ হলে নিশ্চিতভাবে আরও কমবে টাকার মূল্যমান। সংকট বাড়তে পারে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতেতে। মুদ্রানীতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ন্যূনতম পর্যায়ে নামবে। অবশ্য বৈশ্বিকভাবে ভারতীয় রুপির গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে তারা লাভবান হবে। তবে কখনও যদি দুই দেশের বাণিজ্য কাছাকাছি পর্যায়ে আসে, তখন এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ছিল ১৫ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ১৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার। আর রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৭ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। দুটি দেশই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্য। আকুর লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থার কারণে এমনিতেই বাংলাদেশের রপ্তানি সমপিরামাণ অর্থ ভারতকে দিতে হয় না। বাকি ১ লাখ ৫ হাজার ৩০১ কোটি টাকা সমপরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার দেশটিকে দিতে হয়েছে।
বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, ডলারের ওপর চাপ কমাতে ভারতের মুদ্রার অবাধ লেনদেন সম্ভব নয়। এখন ধরা যাক, কারেন্সি সোয়াপের আওতায় দেশটির সঙ্গে টাকা-রুপিতে লেনদেন শুরু হলো। তাদের বাণিজ্য বা ভ্রমণ উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খরচ বেশি। এখন তারা তো আর টাকা নিয়ে ফেলে রাখবে না। কোনো একটি পর্যায়ে তাদের কাছে জমা হওয়া অর্থের সমপরিমাণ ডলার দিতে হবে। না হলে অতিরিক্ত অর্থ বাংলাদেশের বিল, বন্ড বা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। সেটি করলেও বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো তখন আর কোনো বন্ডই কিনতে পারবে না। গত অর্থবছর বিল ও বন্ডের বিপরীতে সরকার নিট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। চলতি অর্থবছর ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অথচ ভারতে রপ্তানির চেয়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণই ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।