সম্পর্কে আমার এক বোনকে পরীক্ষার হল থেকে বের করা হলো৷ তিনি নকলের দায়ে মাত্রই এক্সপেলড। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে৷ পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ গোল মরিচ পুড়িয়ে নাকে ঝাঁঝ দেয়া হলো। খুন্তি দিয়ে জবান খোলা হলো। তিনি ‘আল্লাহ রে...’ বলে চিৎকার করে আবার জ্ঞান হারালেন। এর আগেও এক্সপেলড হয়েছিলেন৷ কিন্তু এবারের প্রতিক্রিয়া বেশি খারাপ।
সীতাকুণ্ড থেকে তার জন্য কোনো এক মগ পুরোহিতের তাবিজ আনা হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল, এই তাবিজ লাগানো থাকলে নকল করার সময় ম্যাজিস্ট্রেট সবই দেখবেন, কিন্তু নকল দেখতে পাবেন না। তিনি সেই ভরসায় টেবিলে ‘পপি গাইড’ রেখে দেখেদেখে লেখা শুরু করেছিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, এই মেয়ে তুমি কী করছো এসব?
- স্যার, কী করছি?
- তুমি বই দেখে লিখছো কেনো?
- স্যার, আপনি কি বই দেখতে পাচ্ছেন?
- এটা কেমন প্রশ্ন? বই দেখতে পাব না কেন?
এরপরই সেই বোন মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
সেই যুগে এসব ঘটনা অহরহ ঘটতো৷ নকলে ধরা পড়লে আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসতো। সান্ত্বনা দিতো। পরের বছর আরো সাবধানে নকল লুকিয়ে পরীক্ষায় বসতে উপদেশ দিতো। 'গাইড বই' ও 'মুরুব্বিদের দোয়া' নিয়ে পরের বছর আবার পরীক্ষায় বসতো।
গতকাল ফেসবুকে পপিকে দেখলাম। পপি গাইডের পপি। আমরা যখন স্কুলে পড়ি 'পপি গাইড' তখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে৷ প্রাণবন্ত ও বড় সহজিয়া ছিলো এই বইয়ের ভাষা। তোতা পাখির মতো এপ্লিকেশন মুখস্ত করত সবাই। প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করত। ট্রান্সলেশনও মুখস্ত করতো।
পাবলিক পরীক্ষার সময় পপি ছোট হয়ে যেতো। নাম হয়ে যেতো ‘পপি টেকনিক গাইড’। সেই বইয়ের সাইজ দুই তিন ইঞ্চি হবে। বইয়ের দাম একশ থেকে দেড়শ টাকা৷ বড় সাইজের বই এক চতুর্থাংশ ছোট করা হতো৷ প্রত্যেক বিষয়ের জন্য ‘টেকনিক গাইড’হতো। এর সুবিধা হলো- দুই পায়ের চিপায় লুকিয়ে রাখা যায়। মেয়েরা পরীক্ষার হলে তাবিজের মতো আস্তিনের নিচে লুকিয়ে রাখতেন৷ সুযোগ বুঝে তাবিজ বের করে ব্যবহার করতো!
নব্বইয়ের দশকে শেষ দিকে বয়ফ্রেন্ড পরীক্ষার সময় প্রেমিকাকে পপি গাইড কিনে দিতেন। ভাই তার বোনকে গাইড কিনে দিতেন। তারা সেই বই দেখে পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষা দিতেন। এখন অবশ্যি সেই নকলের যুগ নেই। অনেকের কাছে তাই এই গল্প অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে শুনে, গ্রামের অনেক সরল পিতা মেয়েকে আলতা সিঁদুরের পাশাপাশি গাইডবই কিনে দিতেন। সেই সময় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ভাবতেন, মেট্রিক পাস দিলে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। পপি ছাড়া আরো এক দুইটি বই চলতো বটে। কিন্তু পপির মতো জনপ্রিয়তা তারা পায়নি।
তখন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল বিরল। ১৭-১৮ শতাংশের এর কপালে পাস জুটতো মাত্র। নকলের দায়ে পরীক্ষার হলেই শতশত ছেলেমেয়ে বহিষ্কার হতো৷ পরীক্ষার কেন্দ্রে পরিবেশ কেমন হতো বলা যাক। পাবলিক পরীক্ষা শুরুর প্রথম দশ মিনিট শিক্ষকরা নকল বাছাইয়ের সুযোগ দিতেন। গাইড থেকে কমন পড়া প্রশ্ন উত্তর ছিড়ে পরীক্ষার্থী নিজের কাছে রেখে দিতেন, অবশিষ্ট বইয়ের পাতা হল রুমের বারান্দায় ছুড়ে ফেলতেন। কিছুক্ষণ পর পিওন বস্তা নিয়ে এসে ছুড়ে ফেলা ছেঁড়া গাইডবই কুড়িয়ে নিতেন। পরীক্ষা কেন্দ্রের জানালা দিয়ে ছেঁড়া বইয়ের বৃষ্টি হতো। পরের বছর যাদের পরীক্ষা, তারা এগুলা কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে ফিরতেন।
পপি গাইড বইয়ের মালিক মালিক আব্দুল মজিদ সাহেব সম্প্রতি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ফেসবুকে দেখলাম পপি তার বাবা আব্দুল মজিদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। বড় মায়াময় সেই দৃশ্য।
আব্দুল মজিদ সাহেব নিশ্চয়ই চাননি তার পপি গাইড পরীক্ষায় 'কপি'র জন্য ব্যবহার হোক৷ তিনি হয়তো চেয়েছিলেন পাড়াগাঁয়ের ছাত্রদের পাঠ্যক্রম সহজ হোক, তার বই সহায়ক হোক। তাদের পাঠ্যপুস্তক ভীতি দূর হোক। তিনি পাঁড়াগায়ে একাধিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ স্কুল করেছেন। তার এসব মহতি উদ্যেগ তাকে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এখানে প্রসঙ্গ হলো গাইড বই নিয়ে নস্টালজিয়া। এখন গাইড বই নেই। নকল নেই। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ শিক্ষাবিদরা গাইড বইয়ের প্রসাররোধের বিষয়ে বলে চলেছেন। গাইড বই ছাত্রদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এটা সত্যও বটে। যদিও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য এখন কমে গেছে বলে শুনি। গাইড বই নিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্যের কথাও শুনি। আবার সুস্থ ধারার বই প্রকাশিত হওয়ারও খবর পাই। তবে ছাত্রদের মানসিক বিকাশ শতভাগ সুষ্ঠু হচ্ছে এটাও বলার সুযোগ নেই। কোথায় যেনো একটি অবক্ষয় থেকেই যাচ্ছে। এখন ইঁচড়ে পাকা ছাত্র বলে দিচ্ছেন সিলেবাস কী হবে। নবম শ্রেণির ছাত্র বলছেন, ডারউইনে তত্ত্ব পড়বেন না। মাধ্যমিকের বালক শিক্ষককে বিজ্ঞান ছেড়ে ধর্ম পড়ানোর উপদেশ দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এখন ধর্ম প্রচারক সেজে বসে আছেন। তিনি বলছেন, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। ছাত্রী বলছে সে গার্হস্থ্যকর্ম পড়বে না। তার মায়েরা টিভি বুমের সামনে বসে মাঠ তাতাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা আন্দোলনের সময় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তারা ‘টাকা’ দিয়ে পড়ছেন। শিক্ষা তাদের কাছে একটি টাকায় কেনা পণ্য মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পিছিয়ে পড়া তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে বক্তৃতা দিতে দেয়া হয় না৷ হুমকি দেয়া হয়৷ আমরা একটি অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
খুব খেয়াল করলে দেখবেন, গাইড বই পেছনে ফেলে এলেও আমাদের মনে গেঁথে থাকা কয়েকটি অদৃশ্য বই আমাদের গাইড করে চলেছে অবিরত। আমরা শত চেষ্টাও এর বৃত্ত থেকে বের হতে পারি না। এই গাইডবই রক্ষণশীল, বিজ্ঞানহীন, কখনো রাজনেতিক পক্ষপাত দুষ্ট কিংবা গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার লোভে অকপট বাজে বকার রোগে আক্রান্ত। কূপমণ্ডুকতা ও ধর্মান্ধতার কালিতে লেখা এই অস্পৃশ্য গাইড বই একটি গোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মগজে ‘কপি’ করে সেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। পরের প্রজন্ম একই মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় বেড়ে উঠছে৷
এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? যে কেউ বলতে পারেন, একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে প্রজন্মের হৃদয়ে খোদাই করা অক্ষরগুলোকে ধুয়ে মুছে সফেদ হৃদয় তৈরি করতে। কিন্তু তেমন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতৃত্বও কোথায় পাই? আমরা এখন মতের অমিল হলে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে গালি দিই, মতের অমিল হলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে গালি দিই, মামুনুর রশীদকে ছোট করি। আমরা কাউকেই প্রণাম্য পণ্ডিত মনে করিনা৷ মতের অমিল হলে অসম্মানজনক মন্তব্য করতে আগপিছ ভাবিনা। ভয়ের ব্যাপার হলো- অপরিণত কিশোররাও মন্তব্য দেয়ার রোগে ভুগছে!
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট