চলতি বছরের জানুয়ারিতে উদ্বোধন হয় ভারতের অযোধ্যার আলোচিত রামমন্দির। উদ্বোধনের ছয় মাস পার না হতেই ফাটল দেখা দিয়েছে মন্দিরটিতে। বৃষ্টি হলেই ছাদ বেয়ে পড়ছে পানি। এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কী কারণে ফাটল ধরলো বাবরি মসজিদ ভেঙে তৈরি হওয়া রামমন্দিরে?
২ দশমিক ৭ একর জমির ওপর নির্মিত রামমন্দির তৈরিতে খরচ হয় ১ হাজার ৮০০ কোটি রুপি। লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে তড়িঘড়ি করেই এটি উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, মন্দিরটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়নি কোনও ইস্পাত বা লোহা। শুধু নির্মাণ শৈলীর উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় কুতুব মিনারের কাছাকাছি উচ্চতার এই মন্দির। ধারণা করা হচ্ছে, মন্দির নির্মাণে কোনও ইস্পাত বা লোহার ব্যবহার না করাই- এর ছাদে ফাটল ধরার প্রধান কারণ।
নির্মাণে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন খোদ মন্দিরটির প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস। তিনি এনডিটিভিকে বলেন, ‘শনিবার (২২ জুন) মধ্যরাতে বৃষ্টি হয়। তারপরই মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদে বড় ফাটল দেখা যায়। সেখান থেকে পূজারির বসার জায়গায় ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করে। ভিআইপি দর্শনের জন্য যেখানে সবাই সমবেত হন সেখানেও বৃষ্টির পানি পড়ছিল।’
সত্যেন্দ্র দাসের দাবি, মন্দির চত্বর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। উপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে এই বিপর্যয়।
তিনি আরও বলেন, ‘এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রকৌশলীরা মিলে রামমন্দির নির্মাণ করেছেন। ২২ জানুয়ারি মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে তবে কেউ জানেন না যে বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে পানি চুঁইয়ে পড়বে!’
তার মতে, এটা খুবই অবাক করা বিষয় যে, বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত মন্দিরে ফাটল ধরেছে। এত বড় বড় প্রকৌশলী থাকার পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটা উচিত নয়।
অন্যদিকে মন্দিরের ট্রাস্ট সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছাদ থেকে পানি পড়ার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করার পর মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশরা মন্দিরে পৌঁছে ছাদটি মেরামত করার নির্দেশ দেন।
মন্দির নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে গণমাধ্যমকে মিশরা জানান, প্রথম তলার কাজ চলছে; এই বছরের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হবে। আর চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মন্দির নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
অন্যদিকে, রামমন্দিরের ফাটলের ইস্যুতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিকেই আঙুল তুলেছে বিরোধীদল কংগ্রেস। বিজেপি’র বিরুদ্ধে মন্দির নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ করে উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস প্রধান অজয় রায় সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শহিদদের কফিন হোক বা ভগবানের মন্দির, এ সবই বিজেপি’র কাছে দুর্নীতির সুযোগ হয়ে উঠেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বিশ্বাস ও পবিত্রতার প্রতীকও তাদের কাছে লুটের সুযোগ মাত্র। শুধু তাই নয়, অযোধ্যার উন্নয়নের ঢোল পিটিয়ে ৬২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রামপথের অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। বিজেপি নির্বাচনী সুবিধা পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে মন্দির নির্মাণ করে অযোধ্যাকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছে।’
আদালতের রায়ে মসজিদের জায়গায় রামমন্দির
রামমন্দির যেখানে তৈরি হয়েছে, তা ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলোর অন্যতম। ওখানেই একসময় ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ।
রামমন্দির ধ্বংস করে ওই মসজিদ গড়া হয়েছিল, এই দাবি তুলে হিন্দু জনতা মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলে। ওই ঘটনার প্রায় তিন দশক পর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বিতর্কিত স্থানটিতে হিন্দু মন্দির বানানোর পক্ষেই রায় দেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের ৫ সদস্যের বেঞ্চ এক সর্বসম্মত আদেশে বলে, অযোধ্যার যে ২.৭৭ একর জমি নিয়ে বহুকাল ধরে বিতর্ক সেখানে রামমন্দিরই হবে। আর মুসলমানদের মসজিদের জন্য ৫ একর জমি দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয় রায়ে।
আদালত বলে, পুরাতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে মন্দিরের মতো একটি কাঠামো পাওয়া গেছে। তবে সেই রিপোর্টে এটা স্পষ্ট নয় যে, ওই পুরনো কাঠামোটি কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল। তা ছাড়া ওই কাঠামোটি ভেঙেই মসজিদ তৈরি হয়েছিল কি না সেই প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ থেকে বিচারপতিরা সিদ্ধান্তে আসেন যে, মসজিদ থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা সেখানে পূজা-অর্চনা বন্ধ করে দেননি। আবার সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড যে প্রমাণ হাজির করেছিল, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে মসজিদে নামাজ পড়া শুরু হয় ১৮৫৬-৫৭ সাল থেকে। তবে দুই সম্প্রদায় দাঙ্গায় জড়ালে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার সেখানে একটি ইটের দেয়াল তৈরি করে দেয়।
সবশেষ ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর মসজিদটি ভেঙে ফেলে উন্মত্ত জনতা। এসময় দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হন। সেসময় মসজিদটি ধ্বংস করাটা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন ছিল বলেও রায়ে বলেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
সূত্র: এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি