দুই পায়েই গুলি লেগেছে। পা দুটোর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করা। ডান পায়ের হাটুর নীচের ক্ষত অনেক বড়। বাম পায়ের গোড়ালীর ক্ষতও কম নয়। ব্যাথায় কাতরাচ্ছে বিছানায়। ঢাকার এক হাসপাতালে পায়েবিদ্ধ গুলি বের করার পর বাড়ি এসে নিরাপত্তার ভয়ে অনেকটা আড়াল করে রাখলেও নিজেকে আর ঢেকে রাখকে পারছিলেন না কিছুতেই। ওষুধপত্র আর উন্নত চিকিৎসার সাধ্যও নেই তার পরিবারের। কথা বলতে চাইলে তাই ভেজাচোখে বেল্লাল (২০) নিজেই জানাচ্ছিল বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলনে যোগদান থেকে তার বর্তমান শারিরিক অবস্থার কথাগুলো।
পুরো নাম তার মো. বেল্লাল ইসলাম। বাবা মো. আলাউদ্দিন গাজী পেশায় সিইনজি চালক। মা সোসা. নাজমা বেগম গৃহিনী। পটুয়াখালীর বাউফলের কালাইয়া গ্রামে বাড়ি। নিজ গ্রাম লাগোয়া কালাইয়া বন্দরের ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০২২ সালে এইচএসসি পাসের পর আর্থিক অনটনে বিএ ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। ইচ্ছে ছিল ছোটখাট উপার্জনে জড়িয়ে পরিবারের আয়ের সহোযোগি হওয়া আর সুযোগমতো বিএ ডিগ্রী অর্জনের। তাই মাস ছয়েক আগে রামপুরা টেলিভিশন ভবন এলাকার টিবিলিংক রোর্ডের এসএ নার্সিং হোম কেয়ার বিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম চাকুরি নেয় সে। গত ৫আগস্ট (সোম বার) বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলনে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকে প্রগতি সরনির মেরুলবাড্ডা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে।
অন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিজয়ের কথায় সামান্য হাসির রেখা ফুটে উঠলেও ব্যাথায় আবার মলিন হচ্ছিল মুখাবয়ব। এমনি আনন্দ-বিষাদের শারিরিক পরিস্থিতি নিয়ে বেল্লাল জানায়, পরিবারের সহায়-সম্বল বলতে বসতঘরের জায়গাটুকু ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। সিএনজি চালক বাবার কামাই রোজগারেও খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। তাই সংসারে আয়ের জোগান দিয়ে ভবিষ্যতে সুযোগমতো বিএ ডিগ্রী অর্জনের ইচ্ছায় ছুটে যায় রাজধানী ঢাকায়। রামপুরা টেলিভিশন ভবন এলাকার টিবিলিংক রোর্ডের এসএ নার্সিং হোম কেয়ার বিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে নেয় পার্টটাইম চাকুরি। ঘটনার দিন বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে বেড়িয়ে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে সড়কে। একই সময় গুলিবিদ্ধ হয় ইফাত নামে নরসিংদী এলাকার অপর একজন। চোখের সামনে মারা যেতেও দেখে সে ইফাতকে। এ সময় উপস্থিত বয়স্ক কয়েকজন মিলে তাকে আফতাব নগরের জহিরুল ইসলাম সিটির সি ব্লোকের নাগরিক স্পেসালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে। তবে সেখানে রোগির ভিরে জায়গা মেলেনি। রাখা হয় হেলথ কেয়ার নামে একই এলাকারই ছোট পরিসরে সদ্য গড়ে ওঠা একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে। দুই দিন পরে খবর পেয়ে ছুটে আসেন নারায়নগঞ্জ এলাকায় পল্লী বিদ্যুতে কর্মরত বড় বোন আখি আক্তার। এরপর তার পায়ের গুলি বের করা হয় বাসাবো এলাকার মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে। গত শুক্রবার (৯ আগস্ট) গ্রামর বাড়ি চলে আসেন বেল্লাল।
বেল্লাল জানায়, পায়ের ক্ষতে ব্যান্ডেস করে দেয় ডাক্তার। ১৫ দিনের আগে কোন কিছু করা যাবে বলে জানায়। ওষুধ নিতে হয় চার ঘন্টা পর পর। মাসে ১টি করে টিকা নেয়া আর এক মাসের আগে সুস্থ্য হওয়ার নয় বলেও ডাক্তার জানায় তখন। এখন পর্যন্ত দুপায়ে ভর করে কোন মতেই দাঁড়াতে পারছেন না সে। ব্যান্ডেসের ভেতরে তীব্র জ্বালাযন্ত্রনা। বিছানায় কাতরাচ্ছে সে। স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে ড্রেসিং করতে গেলে সেখানে গ্রাম্য ডাক্তার বেল্লালের অবস্থা দেখে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিলেও সামর্থ নেই তার পরিবারের। কয়েকদিন আগে ঘরগৃহস্থলীর কাজে গিয়ে পায়ে কারাতের আগাতে গুরুতর আহত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন বাবা আলাউদ্দিন গাজী। শারিরিক অসুস্থ্য মা নাজমা বেগমও।
বেল্লাল ইসলাম বলেন, ‘আমি হৃদয়ের টানেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাসায় থেকে বেড় হয়ে যাই। বসে থাকার উপায় ছিল না ওই দিন। পায়ে গুলি লাগলে সড়কে পড়ে যাই। ব্যাথায় জ্বলতেছিল। বয়স্ক কয়েকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডান পায়ে যে গুলি লেগেছে, তা রাবার বুলেট বা ছররা গুলি নয়। শরীরে ব্যাথা কিছু নয়। পঙ্গু হয়ে গেলে কেমনে চলমু।’
বেল্লালের বাবা সিএনজি চালক আলাউদ্দিন গাজী বলেন, ‘দুইটা ছেলেমেয়ে। কামাই ভাল না। সারাটা জীবন কস্ট করে চলছি। একমাত্র ছেলে বেল্লালের সংসারে সাহায্য করার সঙ্গে পড়াশুনার ইচ্ছে ছিল। ঝামেলায় পড়তে চাই নাই। তাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি কাউকে জানানোর ইচ্ছাও ছিল না। আমিও অসুস্থ। এখন ওর চিকিৎসা চালামু কিভাবে।’
শাড়ির আচলে চোখ মুছে মা মোসা. নাজমা বেগম বলেন, ‘অর গুলি লাগুনের কথা হুইনগ্যা যেন আসমান ভাইঙ্গা মাথায় পড়ছে। সংসারের দুরাবস্থা। ঋন কইর্যা ঘরের কাজ ধরছিলাম। সারাটা জীবন কস্ট কইরগ্যা চলছি। ওর বাপ আর আমিও অসুস্থ। বিছনায় ব্যাথায় কাতরাচ্ছে ছেলেডা। এ্যাহন অরে ভাল চিকিৎসা করানোর কোন টাহা-পয়সা আমাগো হাতে নাই।’