বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বৈষম্যের অবসান চান মাদরাসার জেনারেল শিক্ষকরা - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বৈষম্যের অবসান চান মাদরাসার জেনারেল শিক্ষকরা

মো. জহির উদ্দিন হাওলাদার |

মাদরাসা শিক্ষা উপমহাদেশের একটি প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি। শিক্ষা সংকোচন নীতির ফলে মাদরাসা শিক্ষা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। মাদরাসার কারিকুলাম, সিলেবাস, জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার পরতে পরতে রয়েছে অসঙ্গতি। প্রতিনিয়ত খোড়া অজুহাতে বঞ্চিত হচ্ছেন মাদরাসার জেনারেল শিক্ষকরা। মাদরাসাকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান তকমা দিয়ে আরবি ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষকদের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার ও সহকারী সুপারের মতো প্রশাসনিক পদে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে।

অথচ মাদরাসা মানেই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এ ধারণা সঠিক নয়, কারণ বিশেষায়িত বলতে জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা বুঝায়। কিন্তু আলিয়া ধারার মাদরাসা সাধারণ ধারার শিক্ষার মতোই পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে যা জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করে না, যেমনটা করে থাকে কওমি মাদরাসা। এজন্য কওমি মাদরাসাকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বলা হলেও আলিয়া ধারার মাদরাসাকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বলার সুযোগ নেই।  তাই আলিয়া ধারার মাদরাসার প্রশাসনিক পদে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যেকোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। 

মাদরাসার জনবল কঠামো ও এমপিও নীতিমালার কিছু বিষয়ে হতবাক হয়েছেন শিক্ষকরা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ এ শিক্ষায় অর্জিত ডিগ্রি বা বিএড স্কেল উচ্চতর গ্রেড হিসাবে বিবেচিত হবে না এবং বিএড স্কেল বাদেই সহকারী শিক্ষকরা চাকুরি জীবনে দু'টি উচ্চতর গ্রেড পাবেন স্পস্টভাবে বলা থাকলেও মাদরাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ তে এবং ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে প্রকাশিত সংশোধনীতে এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এছাড়াও স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হলেও মাদরাসায় এ পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং স্কুল-কলেজের নীতিমালায় চাকরিকাল ১৬ বছর পূর্তিতে সব প্রভাষককে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক-সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়েছে কিন্তু মাদরাসার নীতিমালায় ১৬ বছর পূর্তিতে প্রভাষকদের পদোন্নতির সুযোগ দেয়া হয়নি।

এছাড়াও এ নীতিমালায় প্রভাষকদের বঞ্চিত করে ইবতেদায়ি প্রধান, দাখিল মাদরাসার সহ-সুপার ও সুপারকে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের সুযোগ রেখে একটি লজ্জাজনক অধ্যায়ের জন্ম দেয়া হয়েছে, যা বিশ্বের কোন দেশে আছে বলে জানা নেই। এই নীতিমালায় মাদরাসার জেনারেল (নন্ অ্যারাবিক)  শিক্ষকদেরকেও প্রশাসনিক পদে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়নি।

মাদরাসার প্রশাসনিক পদ (সহকারী সুপার, সুপার, উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ) পদ সব শিক্ষকের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। এতে প্রশাসনিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে এবং অপেক্ষাকৃত অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির পদায়ন হবে। দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া মাদরাসা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না। এছাড়া মাদরাসায় প্রশাসনিক পদে কোনো বিষয় বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন নেই, কারণ পাঠদানের জন্য সব বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক আছেন। তাই মাদরাসার প্রশাসনিক পদে প্রশাসনিক  কাজে দক্ষ জনবল নিয়োগ হওয়া অত্যন্ত জরুরি ।

আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের কলকাতায় মাদরাসা-ই-আলিয়া প্রতিষ্ঠার পর ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ খ্রিষ্টান অফিসারদের একটি বিশেষ টিম মাদরাসা তত্ত্বাবধান করতেন। অতঃপর ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালনা কাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তন এনে বিশেষ টিমের পরিবর্তে একজন সেক্রেটারি ও একজন সহকারী সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালনা কাঠামোতো আবারও পরিবর্তন এনে অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৭ বছরে পযার্য়ক্রমে ২৬ জন ব্রিটিশ অফিসার অধ্যক্ষের  দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু ওই সময়ে মাদরাসার স্বকীয়তা নষ্ট হয়নি এবং অনেক মনীষি, আলেম-ওলামা তৈরি হয়েছেন।
 
বর্তমানেও অনেক জেনারেল শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের দ্বারা মাদ্রাসা শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন নজির নেই বরং শিক্ষার মান বেড়েছে। তাই মাদরাসার প্রশাসনিক পদে জেনারেল শিক্ষক নিয়োগ হলে মাদরাসার স্বকীয়তা নষ্ট হবে, এ কথা ভিত্তিহীন বরং এ্যারাবিক ও নন এ্যারাবিক শিক্ষকের সমন্বয়ে মাদরাসার প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করতে পারলে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা পরিপত্রে  নন অ্যারাবিক বিষয়ের সহকারী শিক্ষককে দাখিল মাদরাসার সহ সুপার ও সুপার পদে এবং নন অ্যারাবিক বিষয়ের প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপককে আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ ও ফাযিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছিলো। যা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে জেনারেল শিক্ষক মহলে প্রশংসিত হয়। কিন্তু ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা সংশোধিত পরিপত্রে প্রশাসনিক (সহ-সুপার, সুপার, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ) পদের জন্য  আরবি বিষয়গুলোর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় যার মাধ্যমে দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল সব পর্যায়ের মাদরাসার প্রশাসনিক (সহ-সুপার, সুপার, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ) পদে জেনারেল ( নন অ্যারাবিক) শিক্ষক নিয়োগের বন্ধ হয়ে যায়। 

শিক্ষকদের মযার্দা প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শিক্ষকরা পাঠদানে মনোযোগী হতে পারবেন না। তাই শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করা প্রয়োজন।  সরকারি নিয়মে বাড়ীভাড়া,  উৎসব ভাতা প্রদান এবং স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সমপদে আন্তঃবদলির সুযোগ দিয়ে মেধাবি শিক্ষকদের আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়নে মাদরাসায় স্তর ভিত্তিক পৃথক পৃথক ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে হবে। ইবতেদায়ি প্রথম শ্রেণি থেকে কামিল পর্যন্ত একই ক্যাম্পাসে পাঠদান কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে ইবতেদায়ির শিশু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একই ক্যাম্পাসে পাঠদান করা হয়, এমন নজীর বিশ্বের কোথাও নেই। অত্যাধুনিক যুগে মাদরাসার এ ‘আজব’ দৃশ্য কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

সিলেবাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়,  মাদরাসায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি নম্বরের পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে মাদরাসায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করতে চান না, ফলে মাদরাসায় বিজ্ঞান চর্চা ব্যহত হচ্ছে। যেখানে সরকার জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চায়,  দেশ উন্নয়নের সব সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন বিজ্ঞানমনস্ক, সংস্কৃতিবান, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ সৃষ্টির পরিপন্থী এ সিলেবাস কাম্য নয়। প্রয়োজনে কোরান, হাদীস, বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটিকে আবশ্যিক করে বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের বিষয় সমূহকে দুইটি গ্রুপে বিভক্ত করে উচ্চ শিক্ষার আদলে সিলেবাস প্রনয়ন করে বিজ্ঞান  শিক্ষার্থীদেরকে  উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায় দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হতে পারে। 

এছাড়া জাতীয়করণের ক্ষেত্রেও মাদরাসা বৈষম্যের স্বীকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাত শতাধিক স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করেছেন কিন্তু দুঃখজনক বিষয় এখনও একটি মাদরাসাও জাতীয়করণ করেননি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার ভিত রচনা করেছিলেন। সে সময় তিনি একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাননের দর্শনই ছিলো শিক্ষা জাতীয়করণ। 

শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আজ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য অর্থ জোগান দেয়ার সক্ষমতা সরকারের আছে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান সকল বৈষম্য দূরীকরণ ও মানসম্মত টেকসই শিক্ষা নিশ্চিতকরণ কল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করবেন, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এমনটাই শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা।

লেখক : মো. জহির উদ্দিন হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশন

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006058931350708