শিক্ষক সম্মানিত, শিক্ষকতা মহান পেশা, বিধায় শিরোনামের ‘আকুতি’ নিয়ে পাঠকের আপত্তি থাকতে পারে আবার পাঠ শেষে সহমত পোষণও করতে পারেন। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অতীতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র তেমন ভূমিকা রাখে নাই বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র রাখবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। বলতে গেলে শিক্ষকের মানসম্মত জীবন যাপন ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষক অনন্য অবদান রাখতে পারছেন না। ফলে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য সেমিনার, আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি শিক্ষকরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। অর্থনৈতিক নিপীড়নের সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও যোগ হয়েছে ! যে দেশে আইন প্রণেতাই (এমপি) শিক্ষক নির্যাতন করে সে দেশে শিক্ষকের অধিকার ও নিরাপত্তা দেবে কে? পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায় ২০১২-২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধিক সংসদ সদস্য দ্বারা শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিক্ষককে কান ধরে উঠ বস করানো, হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছেন স্বয়ং আমাদের মহান জাতীয় সংসদ সদস্যরা। এ ছাড়া এই সব কুলাঙ্গার নেতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট চেলা চামচারা শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে জনসম্মুখে ঘুরানো, পুকুরে ফেলে চুবানোসহ বিভিন্নভাবে শিক্ষককে নাজেহাল করেছে ।
বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এসব ঘটনা। হাতে গোনা দুই চারটি ঘটনা জন সম্মুখে আসলেও অধিকাংশ ঘটনা শিক্ষক ভয়ে অথবা মান সম্মানের কথা ভেবে আড়াল করেছেন। শিক্ষক এতোটাই অসহায় হয়েছিলো যে স্বচক্ষে এমন ঘটনা দেখার পরও সবাইকে নিশ্চুপ থাকতে হয়েছিলো। এমনকি ভুক্তভোগী শিক্ষককে বলতে বাধ্য করা হয়েছিলো যে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ নিপীড়িত শিক্ষক বিচার চাওয়ার অধিকারও পাননি। এ ধরনের সংকট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিলো যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নীতি শৃঙ্খলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো, ঘটনাগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়। শিক্ষক সমাজের এহেন দূর্দশার কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে লেখার পরিধি বিশাল হবে। সারাংশ হিসেবে যা বলা যায়, দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, ধর্মীয় রীতিনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দায়ী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। সভ্যতা ও উন্নত জীবনমানের শিক্ষার বিকল্প নেই। যে সমাজ শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, শিক্ষককে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সম্মানিত করেছে সেই সমাজের সভ্যতা ও জীবনমান উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন স্কেল তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর স্কেল। এমপিওভুক্ত শিক্ষকের স্কেলে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বড় স্কেল আছে, টাকা নাই। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা নেই বললেই চলে। এখানে পিওন থেকে অধ্যক্ষ পর্যন্ত সবার বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা, শিক্ষকের উৎসব ভাতা সিকি আনা, চিকিৎসা ভাতা ৫ শত টাকা। পদোন্নতি ও বদলির কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকদের দুর্দশার কথা পত্রিকাগুলো লিখতে লিখতে ক্লান্ত। শিক্ষকদের কথা শোনার গরজ কারো ছিলো না। দু -একজন মন্ত্রী শিক্ষক হিতাকাঙ্ক্ষী থাকলেও এ সংখ্যা নগণ্য। ২০০১-২০০৫ মেয়াদে জোট সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতা ও উৎসব ভাতা চালু করে শিক্ষকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী হছানুল হক মিলন পরীক্ষায় নকল নামের বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলে শিক্ষাকে সুস্থ ধারায় ফিরে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষক নেতারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শিক্ষক নেতারা কেউ সুবিধাবাদী কেউ গর্তবাসী হয়েছিলেন। সুবিধাবাদী দালাল শিক্ষক নেতারা সরকারের দালালি করে নিজেরা আখের গোছালেও শিক্ষকদের জন্য নূন্যতম কিছু করেনি। উপরন্তু শিক্ষকদের কল্যাণ ও অবসর ভাতার বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাট করেছে বলে দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। দালাল শিক্ষক নেতাদের কারণে শিক্ষক আন্দোলন ২০২৩ ভেস্তে যায়।
এমপিওভুক্ত একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরের দিন থেকে শূন্য হাতে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেন। অর্থের অভাবে অবসর জীবনটা চরম দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। কল্যাণ ও অবসর ভাতার টাকার জন্য দালাল ও ঘুষখোরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে রোগে শোকে, বিনা চিকিৎসায় পরপারে পাড়ি জমান। হায় আফসোস! নিজের বেতন থেকে কর্তন করা টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় শিক্ষককে। একজন শিক্ষক ২৫-৩৫ বছর শিক্ষকতা করার পরও অবসরে তাকে বিশাল দলিল দস্তাবেজ জমা দেয়া লাগে। অবসর ও কল্যাণ বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তারা দলিল দস্তাবেজের লিকেজ খোঁজে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে চরম হয়রানি করে এবং ঘুষ নেয়ার ফন্দি আঁটে। অনেকেই আবার ৫ থেকে ১০ ভাগ টাকা দালাল ও অফিসের ঘুষখোরদের দিয়ে ১ -২ বছরের মধ্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। একজন শিক্ষক ২৫- ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে অনেকবার অডিটের মুখোমুখি হন এরপরও কেনো অবসরে বিশাল দলিল দস্তাবেজ জমা দেয়া লাগবে? শিক্ষককের যাবতীয় তথ্য মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ব্যানবেইসসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আপডেট করা থাকে। তাহলে অবসরে যাওয়ার পর শুধু প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়নই যথেষ্ট নয় কি? দলিল দস্তাবেজের কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে দালাল ঘুষখোরদের দৌরাত্ম বন্ধ করা যাবে। জাতির কাছে শিক্ষককে আকুতি করতে হয়, এ বড়ই বেমানান, বড়ই লজ্জার। শিক্ষক মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। পরিশেষে গত বছর একজন শিক্ষকের ভাইরাল হওয়া স্বরচিত কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করে আজকের লেখা ইতি টানছি।
বাঁচার তরে নালিশ নিয়ে, ঘুরেছি বার বার।
কেউ শোনেনি স্যারের কথা,প্রাণ করছে ভার।
সারাদেশের সকল টিচার আশায় ছিলো আজি
একটা কিছু হবে এবার,বলেছে সব কাজী।
স্যারের কথা কেউ রাখেনি
তাইতো ভাবি বসে, শিক্ষকরা কষ্টে
সে কী শুধুই ভাগ্যের দোষে?
লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট