দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন যেন থামছেই না। উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থী নিপীড়নে বরাবরই অভিযুক্ত থাকেন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। শিক্ষকরাও কম যান না। দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগ। শিক্ষার্থী নিপীড়ন, ধর্ষণচেষ্টা, ধর্ষণের মতো বিষয়গুলো প্রায়ই শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। এ নিয়ে আন্দোলনে মাঝেমধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। খুব কম ঘটনায় জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পান, আর অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় বেশির ভাগই বেরিয়ে যান ফাঁকফোকরে। দেখা গেছে, ছাত্ররা বরাবরই নিপীড়নের শিকার হন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের। আবার ছাত্রীরা বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন শিক্ষকদের। শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আকতারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ঘটনা দিন দিন বাড়ছে বলে অভিমত শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদাসীন হওয়ায় এসব ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। আর জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় ৬০-৭০ শতাংশ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করারই সাহস পান না।
তথ্যমতে, ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা নিয়ে রায় দেন হাই কোর্ট। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা ও সুপারিশ করার জন্য একটি অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। ওই রায়ের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হয়। তবে ছাত্রছাত্রীর অনেকেই এ সেল বা কমিটি সম্পর্কে না জানার কারণে এতে অভিযোগ করেন না। অনেক ক্ষেত্রে নিপীড়ক প্রভাবশালী বা ছাত্রনেতা হওয়ায় অভিযোগ করতেও ভয় পান। আবার কারও কারও অভিমত, কমিটির কাছে অভিযোগ করলেও যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যায় না। সব মিলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিপীড়কদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর গতকাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের নিপীড়ন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতায় এমন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় ৬০-৭০ শতাংশ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করারই সাহস পান না। আবার অভিযোগ করলেও অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় আইনে নিপীড়নের শাস্তি নির্ধারণ করা আছে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার হলেও এর ধারাবাহিকতা থাকে না।’ ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে কোনো ধরনের হয়রানি, নিপীড়ন সহ্য করা উচিত নয়।’
জাহাঙ্গীরনগর : ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, তার পরিচিত মামুনুর রশীদ মামুনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনা জাহাঙ্গীরনগর ছাপিয়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে সারা দেশে। সবশেষে এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছয় শিক্ষার্থীর সনদ স্থগিত এবং তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আছে শিক্ষকের বিরুদ্ধেও। ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তাঁর নিজ বিভাগের এক নারী প্রভাষকের অন্তরঙ্গ ছবি ফাঁস হয়। সেই সঙ্গে বিভাগের শিক্ষক পদে আবেদনকারী এক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে ২৭টি কথোপকথন প্রকাশিত হয়। যেখানে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে জোর করে গর্ভপাত করানোর তথ্যও উঠে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান ওরফে জনিকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এক শিক্ষার্থী। এ অভিযোগে নাদির জুনাইদকে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এর আগে নাদির জুনাইদকে বিভাগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাঁর কক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে তালা দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন প্রথম বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই অধ্যাপক সব বর্ষেই একজন-দুজন নারী শিক্ষার্থীকে টার্গেট করেন। তবে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার শঙ্কায় কেউ অভিযোগ করার সাহস পান না।
জগন্নাথ : বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মানিক মুনসীকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিভাগীয় সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রী প্রথমে ওই শিক্ষকের কাছে কাউন্সেলিং ও বিভিন্ন পরামর্শের জন্য আসতেন। এ সুযোগে তিনি ছাত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীকে বিয়ের কথা বলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর আগে জবি নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল হালিম প্রামাণিকের (সম্রাট) বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়ার পর তাঁকে বরখাস্ত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একই অনুষদের ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার বিচার দাবিতে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী। এ নিয়ে দফায় দফায় উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। অভিযোগপত্রে ছাত্রী বলেন, তিনি অভিযুক্ত অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তরের থিসিস করছেন। থিসিস শুরু হওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক তাঁকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করছেন। এই অধ্যাপককে স্থায়ীভাবে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি লালন শাহ হলের ১৩৬ নম্বর কক্ষে এক ছাত্রকে রাতভর র্যাগিং, নগ্ন করে রড দিয়ে মারধর, পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে। এর সঙ্গে অভিযুক্ত মুদাচ্ছির খান কাফি, মোহাম্মদ সাগরসহ অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী। ছাত্র সংগঠনের নেতাদের আশকারা পেয়েই তারা মাঝেমধ্যে এসব অপকর্মে জড়ান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ফুলপরী নামে এক ছাত্রীকে মারধর ও শারীরিক নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করারও অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের কয়েক নেত্রীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সারা দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। পরে এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচজনকে বহিষ্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।