বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু, মানুষ ও পরিবেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের রক্ষাকবচ। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অর্থের যোগানদাতা হিসেবে বৃক্ষের অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণিজগতের অস্তিত্ব উদ্ভিদ জগতের ওপর নিভর্রশীল এবং এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এ থেকে বোঝা যায় বৃক্ষরোপণ আমাদের জন্য কতোটা জরুরি।
বৃক্ষ রোপণ আমাদের গ্রিন হাউসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কাবর্ন ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নিমর্ল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীবজগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির উবর্রতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ্বালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের যোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে, বাড়ি ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় শৌখিন ও মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরিতে কাঁচামালের যোগান দেয়, লবণাক্ততা রোধ করে, মানুষের আপদকালে বীমাতুল্য কাজ করে, মাটির ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে মাটিকে বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখে, বাতাস পরিষ্কার রাখে, বায়ুমন্ডলের তাপ কমিয়ে আবহাওয়া ঠান্ডা রাখে, বায়ু দূষণকারী পদার্থ যেমন-কাবর্ন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দযর্ময় রূপে সাজিয়ে তোলে।
আমাদের অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’ এর আক্রমণে উপকূলে সম্পদের অনেক ক্ষতি হলেও সুন্দরবনের বৃক্ষের কারণে প্রাণহানির পরিমাণ খুবই কম হয়েছিল এবং এটা খুবই স্বস্তিদায়ক ঘটনা। শুধু ঘূর্ণিঝড় আম্পান' এর ক্ষেত্রেই ঘটেনি। এর আগে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বরে ‘বুলবুল’, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ এবং ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনের বৃক্ষে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল; প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় বর্মনের মতো কাজ করে সুন্দরবন।
পযার্প্ত পরিমাণ বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাতাসে কাবর্ন-ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীব বৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কাবর্ন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। এসিড বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরু অঞ্চল ও এন্টারটিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলীয় এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের। এজন্য বৃক্ষ রোপণের কোন বিকল্প নেই।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে শুধু দেশের উত্তরাঞ্চল নয়, সারা দেশেই এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণে বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। অত্যন্ত জরুরি হলেও বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস এদেশে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হচ্ছে না। তবে মরুকরণ রোধে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। মরুকরণ বিস্তার রোধে অধিক বৃক্ষ রোপণই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আমরা সকলে সবুজের কাছাকাছি থাকতে চাই। ইচ্ছে করলেই আমরা ইট-কংক্রিটে গড়া ঘরের ভেতর-বাহির মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারি। অনেককেই বাসার বারান্দায়, সিঁড়ির পাশে, বসার ঘরে ইত্যাদি স্থানে গাছের টব রাখতে দেখা যায়। গাছ-প্রেমীদের জন্য বর্তমান সময়টা খুবই উপযুক্ত । গাছ লাগানোর সঠিক মৌসুম চলছে। বাসা-বাড়ির টবে, ছাদ, বাগান বা খোলা জায়গায় বাগান করতে চাইলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। হাত বাড়ালেই আশেপাশে পাওয়া যায় চমৎকার সব নার্সারি, যেখান থেকে পছন্দ মতো গাছ সংগ্রহ করা যায়। ফুল, ফল, সৌন্দর্য বর্ধনকারী লতাগুল্ম, ঔষধি বৃক্ষ, বনসাইসহ সবই নার্সারীতে পাওয়া যায়। টব, কীটনাশক, জৈব সার, মাটি, উপকরণসহ গাছের পরিচর্যা বিষয়ক সব কিছু।
মে থেকে আগস্ট- এই চার মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময়ের মধ্যে গাছ লাগালে তা উপযুক্ত আবহাওয়ার মধ্যে বেড়ে উঠতে পারে। এ সময় গাছের দ্রুত বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা পাওয়া যায়। টবে বা বাগানে লাগানো চারাগুলো এ সময় সহজেই নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এ সময় ফুল, ফল, পাতাবাহার বা বনজ সবই লাগানোর উপযুক্ত সময়। আসুন আমরা সকলে গাছ লাগাই, জীবন ও পরিবেশ বাঁচাই।
লেখক : মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলাম লেখক