বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার জন্য উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য - দৈনিকশিক্ষা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার জন্য উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য

প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

শিক্ষার্থীর উন্নত জীবন নির্ভর করে উন্নত শিক্ষার ওপর। উন্নত শিক্ষা পেলে সে নিজেই নিজেকে সফল করতে পারে, নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে পারে। সে কখনোই চাকরির পেছনে দৌড়াবে না, কোনো তদবির করতে হবে না, বরং চাকরি তার পেছনে দৌড়াবে, এমনকি উন্নত বিশ্বও তাকে পেতে প্রাণপণ চেষ্টা করবে।

বিদেশে উন্নত শিক্ষা নিয়ে বিদেশেই উন্নত জীবন গড়ে নিয়েছে এমন বাঙালির সংখ্যা অনেক। সেখানে তারা ছাত্রজীবনের ন্যায় কর্মজীবনেও সুনাম বা কৃতিত্ব অর্জন করেছে। নিজে কর্ম তৈরি করে নতুন নতুন উদ্ভাবন করে সেই রাষ্ট্রকে নতুন পথ দেখিয়েছে। সুতরাং উন্নত শিক্ষাই শিক্ষার্থীর জীবনমান নিশ্চিত করতে পারে, বেকার সমস্যার সমাধানও করতে পারে। 

সরকারি চাকরি কখনোই বেকার সমস্যার শতভাগ সমাধান করতে পারে না। বেকার সমস্যা সমাধানের উপায় একমাত্র উন্নত শিক্ষা। উন্নত শিক্ষা শুধু বেকার সমস্যারই সমাধান নয়, তারাই রাষ্ট্রকে উন্নত করতে পারে। উন্নত শিক্ষা চালু বা বাস্তবায়ন করতে পারলে রিজার্ভ ব্যয় করে বিদেশে পড়তে যেতে হবে না, বরং বিদেশিরা অধ্যায়নের জন্য এদেশে আসবে, এতে এদেশের রিজার্ভ সমৃদ্ধ হবে।

দীর্ঘ ৫৩ বছরে বাংলাদেশে বহু কিছু উন্নত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা উন্নতি হয়নি। বলা অমূলক হবে না যে, বিদেশি প্রেসক্রিশন আমাদের শিক্ষাকে উন্নত হতে দেয়নি। বরং প্রচুর অর্থ অনুদান বা ঋণ দিয়ে আমাদের শিক্ষাকে তালগোলের মধ্যে রেখেছে, ভিন্নদিকে ডাইভার্ট করেছে। তাদের দর্শনের গোলকধাঁধায় আমাদের শিক্ষার মহারথীরা জাতিকে ঘুরপাক খাইয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে, এ কথা বলতে দ্বিধা নেই। আর সে জন্য একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে নানান কৌশলে শিক্ষাবিদদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। সব সরকারই প্রশাসনকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ক্ষমতাকে মজবুত করতে আত্মনিয়োগ করেছে, আমলাদের ওপর নির্ভর হয়ে নির্বাচনী বৈতরণি পার হবার লক্ষ্য নিয়েই চলেছে। ফলে শিক্ষার গুরুত্ব কখনো দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। 

শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত বর্তমান সরকারের কাছে প্রধান দাবি থাকবে উন্নত শিক্ষা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। সে জন্য  ১. শিক্ষায় কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়া ২. কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হতে না দেয়া ৩. শিক্ষা নিয়ে কোনো রাজনীতি না করা, ৪. শিক্ষাকে আমলামুক্ত করা ৫. প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষকের বেতন আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা ৬. প্রয়োজনে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শিক্ষক গবেষকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া (উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্যদেশের শিক্ষকরা অধ্যাপনা করেন), ৭. কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানের করা ৮. সকল বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা, যাতে সকল ডিসিপ্লিন থাকে এবং সব মেধাবীদের আগ্রহ অনুযায়ী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার খোলা থাকে ৯. উচ্চশিক্ষার শিক্ষকদের গবেষণা বাধ্যতামূলক করা। এ জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তি ও অন্যান্য প্রণোদনামূলক সুবিধা প্রদান করা এবং প্রত্যেকের গবেষণা অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা ১০. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদেরকেও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা ও গবেষককে ইনসেন্টিভ দেয়া ১১. মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ইংরেজিতে দুর্বল বা অপারদর্শী, তাদেরকে ঐচ্ছিকভাবে ইংরেজির পরিবর্তে কারিগরি বিষয় নেবার সুযোগ দেয়া, তারা বি-লেবেল সনদ পাবে (ইংরেজি না নেয়ার কারণে শর্ত থাকবে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না) ইংরেজি শিক্ষা ব্যতীত দেশি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ দেয়ার লক্ষ্যে কম মেধাবীদের জন্য এই ব্যবস্থা রাখতে হবে, এতে মাধ্যমিকে কেউ ঝরে পড়বে না এবং কারিগরি শিক্ষার দ্বারা তাদের আয়ের পথ তারা করে নিতে পারবে, এমনকি বিদেশেও যেতে পারবে ১২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা বা গভর্নিং বডি নামক কমিটি বাতিল করতে হবে। তদারকির দায়িত্ব মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা/জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা/বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা/জেলা প্রশাসন/শিক্ষা বোর্ড, মাউশি/সর্বোপরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পালন করবে। প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে টিম গঠন করে শিক্ষার মান তদারকি করানো যেতে পারে, ১৩. সকল স্তরের শিক্ষকের পদোন্নতিতে পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিতে হবে, গবেষণা অভিসন্দর্ভ বা প্রবন্ধের শর্ত থাকতে হবে, ১৪. শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে ১৫. শিক্ষকের চাকুরির বয়স ৬৫ করতে হবে, ১৬. শিক্ষক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ১৭. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করে শিক্ষকদেরকে একই নিয়োগ নীতিমালায় আনতে হবে ১৮. সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর সব পরীক্ষার উত্তরপত্র অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের দ্বারা মূল্যায়ন করাতে হবে ১৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ফি নগদ পরিশোধ করা যাবে না, ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে এবং ২০. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আয়-ব্যয় ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২, ৬২, ৬৪, ৬৯, ৭০, ৭১, ৯০ এবং ২০২৪ এর আন্দোলনের সফলতা একমাত্র ছাত্রদের। নিম্নমানের শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের হতাশার কারণেই বারবার ছাত্ররা রাজপথে নেমেছে। বেকারত্ব জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজ, অনৈতিক পথে হাঁটা, বৃত্তবান বা নেতাদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া প্রভৃতি পথে বেকারদেরকে যেতে যে বাধ্য করে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এতো সফল আন্দোলন করেও ছাত্ররা কখনোই তার সুফল পায়নি, সুফল রাজনৈতিক নেতাদের হাতেই চলে গিয়েছে প্রতিবার। এবার সুযোগ এসেছে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত শিক্ষা চালুর পরিকল্পনা নেয়ার। কারণ, বর্তমান সরকার ছাত্র আন্দোলনের ফসল, সরকার নির্দলীয়, এখনো সরকারের চালিকাশক্তি শিক্ষার্থীরা। এবারের আন্দোলনও অতীতের চেয়ে ব্যতিক্রম। এ আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। লক্ষ্যই শিক্ষা ও চাকুরি তথা বৈষম্যমূলক ভবিষ্যৎ হতে পরিত্রাণ পাওয়া। তাই আমি মনে করি এবং দাবি করি, সরকার ছাত্রদের টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কাজকে সর্বাগ্রাধিকার দেবে, শিক্ষার ও ছাত্রদের ভবিষ্যৎ পেশার বৈষম্য দূর করবে। 

সরকার অনেক সংস্কারের পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না, ফলপ্রসূ হবে না, যদি না উন্নত শিক্ষা বাস্তবায়ন না করে। উন্নত শিক্ষা বাস্তবায়িত হলে অন্য কোনো সংস্কারেরই প্রয়োজন হবে না বলে মনে করি। কারণ, উন্নত শিক্ষার প্রডাক্ট উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্যই যথেষ্ট হবে। এমন একটি মহৎ কাজের মাধ্যমেই এ সরকার শিক্ষার ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে এবং ছাত্রদের ঋণ শোধ করতে পারে। 

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড

তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কমিটি - dainik shiksha তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কমিটি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির দাবি - dainik shiksha স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির দাবি ঢাবিতে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ - dainik shiksha ঢাবিতে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজকে ভাসানী নামকরণের দাবি - dainik shiksha শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজকে ভাসানী নামকরণের দাবি এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচির সমন্বয় সভা কাল - dainik shiksha এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচির সমন্বয় সভা কাল ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর - dainik shiksha ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073070526123047