বিয়ে, মেজবানের মতো যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনে বোরহানি খুবই জনপ্রিয় পানীয়। হজমে সহায়ক এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে তৈরি করা হয় বলে সব বয়সী মানুষের বোরহানির প্রতি রয়েছে বাড়তি টান। টক-ঝাল স্বাদের বোরহানি যতটা না সুস্বাদু, এর চেয়ে এই পানীয়র পুষ্টিগুণ শরীরের জন্য দারুণ উপকারী।
গবেষকরা বলছেন, বোরহানি পানের মাধ্যমে পেটে যায় 'উপকারী' ব্যাকটেরিয়া! কেননা, বোরহানিতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া। যেগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া। বোরহানির ব্যাকটেরিয়াগুলো যে অন্ত্রের বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে, সেটা উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন গবেষকরা। বোরহানির প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে দেশে এটিই প্রথম কাজ বলে দাবি সংশ্নিষ্ট গবেষক দলের।
গবেষণাটি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ এবং অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানিম জাবিদ হোসাইন। এতে সহতত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌসী আলী। গবেষণা সহকারী ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ইকবাল হোসেন নাফিজ, হালিমা আক্তার মজুমদার ও খাদিজা আক্তার।
গবেষণাটি আন্তর্জাতিক 'কারেন্ট রিসার্চ ইন নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স' জার্নালে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় সংগ্রহ করা ২১টি ব্যাকটেরিয়া পর্যবেক্ষণ শেষে পাঁচ ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রোবায়োটিক উপযোগিতা নিয়ে গভীর পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে Lactobacillus fermentum এবং Lactobacillus bravis প্রজাতিভুক্ত ব্যাকটেরিয়া জীবাণুরোধী ভূমিকা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কাজ প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষকদের মতে, বোরহানির সঙ্গে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়াও আমরা খাচ্ছি, যা আমাদের হজমশক্তি বাড়াচ্ছে। ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও অন্য পুষ্টি উপাদানও তৈরি করছে। অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যের গুণগত মান বাড়ানো, ক্ষতিকর জীবাণু প্রতিরোধ, সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে গবেষণায় পাওয়া স্টেনগুলোকে ফাংশনাল ফুড আর ওষুধ প্রস্তুতসহ নানা উপকারে কাজে লাগানো যাবে বলে মনে করেন তাঁরা।
বোরহানির এই যে উপকারিতা- এর জন্য অণুজীবেরও কিছু ভূমিকা আছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাঁরা জানান, উপকারী অণুজীব বোরহানির প্রোবায়োটিক নিয়ে কাজ শুরু হয় বছর চারেক আগে। উদ্দেশ্য ছিল, সচরাচর খাওয়া হয় এমন দেশীয় বেভারেজ থেকে ভালো ভালো প্রোবায়োটিক স্টেন খুঁজে বের করে সেগুলো ফাংশনাল ফুড আর স্টার্টার কালচার তৈরিতে ব্যবহারের উপযোগিতা যাচাই করা। নানা দিক বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে যে বেভারেজটি তাঁদের কাছে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে, সেটি বোরহানি।
এ ব্যাপারে গবেষক দলের প্রধান প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানিম জাবিদ হোসাইন বলেন, 'গবেষণাকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে বোরহানি খাওয়ার মাধ্যমে যে ভালো ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া শরীরে যায়, এর প্রমাণ পেয়েছি আমরা। আমরা যখন বোরহানি পান করি তখন বিভিন্ন অণুজীবের পাশাপাশি উপকারী স্ট্রেনগুলোও হয়তো আমরা খেয়ে থাকি। যা আদতে আমাদের জন্য একটি বাড়তি লাভ। কারণ, বোরহানি থেকে পুষ্টি তো আছেই, সঙ্গে এই উপকারী স্ট্রেনগুলো থেকে পাওয়া যাবে বিভিন্ন প্রোবায়োটিক গুণাগুণও।'
গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হিসেবে গবেষকরা একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁদের মতে, এর আগেও অন্য গবেষণায় একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত কিছু প্রোবায়োটিক স্ট্রেনের উল্লেখ আছে, যাদের উৎসও দুগ্ধজাত খাদ্য। এতে গবেষকরা ধারণা করেন, এই অণুজীবগুলো খুব সম্ভবত বোরহানিসহ বিভিন্ন ডেইরি পানীয় ও খাদ্যপণ্যে সচরাচর কমবেশি পাওয়া যায়।