রাজধানীতে ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশন থেকে আগে নকশার অনুমোদন নিতে হবে। এত দিন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে সরাসরি নকশার অনুমোদন নিলেই হতো। সিটি করপোরেশন সায় দিলে রাজউকে আবেদন করে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে।
এ নিয়ম আপাতত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় কার্যকর হবে। এ জন্য ফিও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দিয়েছে ডিএসসিসি। বিষয়টি নিয়ে গত ২৮ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাও হয়েছে। প্রবিধানমালায় সাংঘর্ষিক কিছু বিষয় থাকায় সেগুলো সংশোধন করে খুব শিগগির এটা কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। এ নিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন ভবনের অনুমোদন দিলে রাজউকের কাজ কী হবে? আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের নিয়ম করলে ভবনের আবেদনকারীদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজউকের ব্যর্থতার কারণেই আজ ঢাকা জঞ্জালের নগরীতে পরিণত হয়েছে। তারা ঠিকভাবে ঢাকা শহরের জন্য পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ জন্যই সিটি করপোরেশনের এ উদ্যোগ।
এ ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, 'রাজউক তো কাজ করছেই। সিটি করপোরেশনেরও তাদের কাজ আছে। তারা তাদের কাজ করবে। আমরা আমাদের কাজ করব। একই কাজ করার জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।'
প্রবিধানমালা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একটি ভবন তৈরি করতে হলে ৪০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ৯০ শতাংশ ভবনের ক্ষেত্রেই সেই জায়গা ছাড়া হয়নি। ডেভিয়েশন করে প্রতিটি ভবনের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। বৃষ্টির পানি রিচার্জের জন্য যে স্থানটি উন্মুক্ত রাখার কথা, সেখানে কংক্রিট বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের সমস্যা হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। এক কথায় সার্ভিস দিতেও সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য আইনের মধ্য থেকেই এ প্রবিধানমালাটি তৈরি করা হয়েছে। এখন ভবনের অনুমোদন নিতে গেলে আগে সিটি করপোরেশন থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। সিটি করপোরেশনও ভবন নির্মাণের বিষয় তদারকি করবে। এটা করা গেলে রাজধানী শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।'
এ ব্যাপারে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'এক সময় সিটি করপোরেশন থেকে একটি অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বিধান ছিল। তবে আবেদনকারীদের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন দপ্তরকে বাদ দিয়ে মাত্র চার-পাঁচটি সংস্থার অনাপত্তিপত্র নেওয়ার নিয়ম করা হয়। এখন সিটি করপোরেশন বলছে, তারা যেহেতু রোড ম্যানেজমেন্ট করে, নানা সেবা দেয়- এ জন্য তারা লিগ্যাল ম্যান্ডেট চাইছে। তবে তারা প্রবিধানমালায় এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ জন্য প্রবিধানমালাটি এমনভাবে করতে বলা হয়েছে, যাতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক থেকে ১৬ দিনের মধ্যে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো উল্লেখ করে রাজউককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রাজউক এখন এ নিয়ে কাজ করছে। যথাসময়ের মধ্যেই রাজউক প্রতিবেদন দেবে।'
জানা গেছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে রাজধানীতে ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকেও অনুমতি নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন। এর পরই ডিএসসিসি প্রবিধানমালা তৈরির কাজ শুরু করে। তাদের প্রবিধানমালার নাম দেওয়া হয়েছে, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আওতাধীন এলাকায় ভূমি উন্নয়ন, ইমারত নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ প্রবিধান ২০২২।'
প্রবিধানে বলা হয়েছে, প্রয়োজন অনুযায়ী ১৭টি ফরমে আবেদন করতে হবে। প্রতিটি ফরমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। ভবনের ফ্লোর স্পেসের প্রথম ৫০ বর্গমিটারের জন্য ফি ধরা হয়েছে ১৫০ টাকা। ১০০ বর্গমিটার পর্যন্ত ৩০০ টাকা, ২০০ বর্গমিটার পর্যন্ত ৫০০ টাকা। এভাবে ৩০ হাজার বর্গমিটারের বেশি হলে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তি করা হবে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে। আবেদন ঠিক না থাকলে কারণ উল্লেখ করে তা নামঞ্জুর করা হবে। আবেদনকারী আপিল করলে পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে। ইমারত নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার ২৪ মাসের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে। আবেদনকারী কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হলে সময়সীমা আরও ১২ মাস বাড়ানোর সুযোগ থাকবে। তবে এ সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করতে না পারলে নকশার অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে নতুন আবেদন করে অনুমতি নিতে হবে। এসব কার্য সম্পাদনের জন্য করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। কমিটির অন্য সদস্য থাকবেন সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী, সংশ্নিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও আইন কর্মকর্তা।
রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিএসসিসির প্রণীত প্রবিধানমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে অন্তত ৩০ অথরাইজড অফিসার, ৩০ সহকারী অথরাইজড অফিসার, শতাধিক নকশাকার, শতাধিক ইন্সপেক্টরসহ অন্তত হাজারখানেক জনবল লাগবে। তারা তো মশাই মারতে পারে না। তাহলে তারা নকশার ছাড়পত্র কীভাবে দেবে?
প্রবিধানমালার সংক্ষিপ্তসার দেখেছেন উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি প্যারালাল কার্যক্রমের মতো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। বাস্তবতা হলো, রাজউক তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। যে কারণেই এটা হয়েছে। আবার এটাও ঠিক, সিটি করপোরেশনেরও সক্ষমতা নেই। যে ধরনের একটি প্ল্যানিং উইং সিটি করপোরেশনের থাকার কথা- তা নেই। এই জনবল দিয়ে এই সেবা দেওয়াও সম্ভব নয়। আবার এতে মানুষের ভোগান্তিও বাড়বে। তবে একটি নগর সরকার ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে ভালো।