ভালো মা তবে ভালো সন্তান - দৈনিকশিক্ষা

ভালো মা তবে ভালো সন্তান

ড. মো. মাহমুদুল হাছান |

ভালো মা মানে ভালো সন্তান। মায়ের গুণাগুণ সন্তানের মধ্যে বেশি প্রতিফলিত হয়। মা যা করেন, যা ভাবেন এবং যা বলেন, তার ওপরে সন্তান অনেকটাই বেশি প্রভাবিত হয়। কোনো ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে ভালো মায়ের সংজ্ঞা নির্ণিত হয়। বেশিরভাগ প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ একমত যে, সন্তানের প্রতি যে মায়ের ভালোবাসা নিশ্চিতভাবে অনুভূত হয়, তিনিই ভালো মা। কীভাবে একজন মা ভালো মা হবেন, তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তবে এমন কিছু নির্দেশিকা রয়েছে যা আপনি আপনার সন্তানদের জন্য প্রয়োগ করতে পারেন। সুতরাং আপনি যদি মা হয়ে থাকেন তাহলে সন্তানের কাছে ভালো হওয়ার জন্য আপনাকে কিছু নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।

ড. মো. মাহমুদুল হাছান 

যথেষ্ঠ স্নেহ দেখান: আপনার সন্তানদেরকে আলিঙ্গন, চুম্বন এবং প্রশংসার মাধ্যমে প্রচুর ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন। স্নেহ আপনার সন্তানকে মনে করিয়ে দেয় যে, আপনি তাদেরকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসেন। এ ছাড়া, এটি আপনার সন্তানের উচ্চ আত্মসম্মানবোধ বৃদ্ধি করে, উন্নত একাডেমিক কর্মক্ষমতা বাড়ায়, আচরণগত সমস্যা দূর করে এবং আপনার ও আপনার সন্তানের মধ্যে সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী সম্পর্ক স্থাপন করে। মনে রাখবেন, আপনার সন্তানদের সঙ্গে আপনার বেশিরভাগ মিথস্ক্রিয়া ইতিবাচক এবং প্রেমময় হতে হবে। তাই প্রতিদিন তাদেরকে স্নেহ দেখানোর চেষ্টা করুন।

সন্তানদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটান: দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গুণগত সময় গুরুত্বপূর্ণ। আপনার যদি একাধিক সন্তান থাকে, তবে একটি দল বা গ্রুপভিত্তিক না হয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় দেয়ার চেষ্টা করুন। এমনকি অল্প সময়ের সঙ্গও আপনার দুজনের মধ্যে বন্ধনকে শক্তিশালী করতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, আপনি যদি একটি শিশু বা ছোট সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান, তাহলে তার সঙ্গে বাসার মেঝেতে, গাছতলাতে, বেলকনিতে বা বাড়ির আঙিনায় হলেও সময় কাটাবেন এবং প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে খেলা করবেন। 

সন্তানদের সাপোর্ট দিন: আপনার সন্তানকে উপযুক্ত বা যোগ্য বানাতে আপনার সন্তানের ইচ্ছা ও আগ্রহগুলোকে মূল্যায়ন করুন। এমনকি, আপনার পছন্দ না হলেও, কখনো কখনো আপনার সন্তানের আগ্রহ ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিন, এতে আপনার সন্তানের আত্মসম্মান বৃদ্ধি পাবে এবং তারা জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠবে। বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ জাগতে পারে এবং কখনো কখনো কোনো কিছুর প্রতি অনাগ্রহও আসতে পারে, তাই তাদের এ জাতীয় আগ্রহ-অনাগ্রহের ওপর ভিত্তি করে আপনার ইচ্ছাকেও পরিবর্তন করতে হবে এবং তাদেরকে সাপোর্ট করতে হবে। তবে, কোনো খারাপ বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হলে তা থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টাও করতে হবে। 

সন্তানদের নিঃশর্ত ভালোবাসুন: আপনার সন্তানকে অকৃত্রিম ও নিঃশর্তভাবে ভালোবাসুন। এটি আপনার সন্তানদের নিজেদের এবং আপনার প্রতি আত্মবিশ্বাসী বোধ করতে সাহায্য করবে। এমনকি, যদি আপনার সন্তান গণ্ডগোল করে বা আপনাকে তাদের শাসন করতে হয়, তবুও তাদের বোঝাতে হবে যে, আপনি তাদেরকে ভালবাসেন। একজন অভিভাবক মা হিসেবে, আপনার উচিত হলো, আপনি আপনার সন্তানকে ভালোবাসবেন এমনভাবে যেনো সে বুঝতে পারে যে আপনার ভালোবাসা আন্তরিক এবং নিঃস্বার্থ। এজন্য  আপনার সন্তানের ভুলের জন্য শুধুমাত্র সমালোচনা বা দোষারোপই করবেন না বরং পরবর্তীতে তারা কীভাবে তাদের ভুল সংশোধন করতে পারে এবং ভবিষ্যতে আরো কী ভালো কাজ করতে পারে তার ওপর ফোকাস করুন।

স্পষ্ট ও দৃঢ় নিয়ম সেট করুন: আপনি আপনার সন্তানের কাছ থেকে কী আশা করেন এবং কতোটুকু বা কীভাবে আশা করেন, তা সঠিক ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবেন। সেজন্য, তাদের সঙ্গে সর্বদা কথা বলুন এবং কোনোটি সঠিক এবং কোনটি ভূল, তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলুন। কী করণীয় বা বর্জনীয় তার নির্দেশিকাগুলো মৌখিকভাবে রূপান্তর করতে একটি পারিবারিক বৈঠক করে নিশ্চিত করুন। প্রত্যেকে যদি তা মেনে না চলে তবে তাদেরকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ সকল বিধি-নিষেধ একত্রিত করে লিখিতভাবে বাড়ি বা বাসার কোথাও লাগিয়ে রাখা যেতে পারে। 

আপনার সেট করা নিয়মগুলোর ফলোআপ করুন: আপনি নিয়ম তৈরি করেছেন এবং আপনার সন্তানদের সেগুলো অনুসরণ করার জন্য নির্দেশনাও দিয়েছেন। সুতরাং তারা সেগুলো মানছে কি না বা কোনোটির প্রতি অবহেলা করছে কি না, সে ব্যাপারে আপনাকে ফলোআপ করতে হবে। কোনো নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, প্রয়োজনে তাকে শাস্তি ভোগের জন্য সতর্ক করতে হবে এবং ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করতে হবে। মোটকথা, আপনি নিশ্চিত করুন যে, আপনি যে নিয়মগুলো সেট করেছেন, তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করছেন, যাতে আপনার সন্তানরা জানতে পারে যে, আপনি বলেছেন এবং তা করতেও চান। 

আপনি যা বলেন তা অনুশীলন করার চেষ্টা করুন: আপনি আপনার সন্তানদের জন্য যে উদাহরণ স্থাপন করতে চান, সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। আপনি যদি তাদের মিথ্যা না বলতে বলেন, আপনারও মিথ্যা বলা উচিত নয়। আপনি যদি প্রায়ই স্বাস্থ্যকর খাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেন, তাহলে একটি সুষম খাদ্যে আপনি লেগে থাকার চেষ্টা করুন। আপনি যদি নিজে সেগুলো অনুসরণ করেন তবে সন্তানদের নিয়মগুলো অনুসরণ করার সম্ভাবনা বেশি। ধরুন, আপনি চান আপনার সন্তান কঠোর পরিশ্রমী হোক এবং সে মাদকদ্রব্যাদি পরিহার করে সুস্থ থাকুক, তাহলে আপনাকেও সেগুলো মেনে চলতে হবে।
আপনি ভুল করলে স্বীকার করুন: আপনি একজন ভালো মা হতে চান এবং মনে করুন আপনি একজন ভালো মা। কিন্তু আপনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন, আপনার ভুল হতে পারে এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং আপনি যখন আপনার সন্তানের সামনে ভুল করে তা স্বীকার করেন এবং সেজন্য দুঃখ বোধ করে ক্ষমা চান, তাহলে দেখবেন আপনার সন্তান আপনাকে আরো বেশি সম্মান করবে এবং শিক্ষা নেবে যে, ভুল করলে ক্ষমা চাইতে হয়। ভুলের জন্য লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, বরং  ভুল করে তা সংশোধন করে নেয়া একটি মহান শিক্ষা, যা মায়ের কাছ থেকেই সন্তানরা শিখে থাকে।

আপনার সহ-অভিভাবকের সাহায্য নিন: ভালো মায়েরা নিজেরাই সবকিছু করার চেষ্টা করেন না, সন্তান পালনে তারা অন্যের সাহায্য নিয়ে থাকেন। ভালো মা হতে আপনি যদি আপনার সন্তানের লালনপালন করার জন্য কোনো অভিভাবকের প্যারেন্টিং মেনে নেন, তাহলে তাদের সঙ্গে আপনার দায়িত্বটি শেয়ার করুন, আপনার দায়িত্বের বোঝা অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। নিযুক্ত সহ-অভিভাবকের সেবায় আপনি অভিভূত হলে, তাকে অনুরোধ করুন, যেনো তারা আপনার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন এবং তাদের সঙ্গে আপনার কাজ ভাগ করে আপনার দায়িত্বের বোঝা লাঘব করুন। এটি এমন হতে পারে যে, আপনার কোনো ক্লান্তি হচ্ছে, আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন এবং আপনি এজন্য ঘুমাতে চান, তাহলে আপনি আপনার সহ-অভিভাবকে বলুন, সে যেনো আপনার সন্তানের দেখভাল করে এবং আপনাকে এ মুহূর্তে যেনো কেউ বিরক্ত না করে। আর যদি আপনার সহ-অভিভাবক না থাকে তাহলে আপনার সন্তান যাদের কাছে থাকতে অভ্যস্ত, তাদেরকে আপনার প্রয়োজনীয়তার কথা শেয়ার করুন এবং সন্তানের যত্নের বিষয়ে সচেতন থাকুন। 

সন্তানের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক রাখুন:  আপনার সন্তানদের দেখান কীভাবে মানুষের সঙ্গে সঠিকভাবে সঠিকভাবে আচরণ করতে হয়। আপনি আপনার স্ত্রী, সহ-অভিভাবক, পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশি বা অপরিচিত লোকজন; যাদের সঙ্গিই থাকুন না কেনো, আপনার সর্বদা তাদের সঙ্গে সম্মান এবং দয়াসুলভ আচরণ করা উচিত। আপনার সন্তানদের জানতে দিন এটি একটি ভালো বন্ধু বা একে অন্যের সঙ্গী হওয়ার অর্থ কী এবং তাদেরকে এটিও দেখান যে আপনি কীভাবে যত্নসহকারে তাদের কথা শোনেন, আপস করেন এবং অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করেন। যখন আপনি এবং আপনার স্ত্রী তথা আপনার সন্তানের মায়ের সঙ্গে যেকোনো হালকা বা তুচ্ছ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন বা কোনো সামান্য ব্যাপারে মতভেদ হয়,  আপনার সন্তানদের শেখান, যে কীভাবে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েও কাজ করতে হয় এবং একে অন্যের সঙ্গে আপস করতে হয়। 

প্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক থাকুন: তথ্য-প্রযুক্তির এ সম্মৃদ্ধির যুগে আমাদের এ প্রজন্ম অনেক অগ্রসরমান। সুতরাং মা’কে এ ব্যাপারে অনেক সচেতন ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। সন্তানের উন্নতি ও অগ্রগতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান যুগের লেখাপড়া, ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরিসহ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ইন্টারনেটের ব্যবহার অত্যন্ত আবশ্যক। এ ব্যাপারে সন্তানকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দিতে হবে। তবে, একজন আদর্শ মা হিসেবে, তার সন্তানকে শৈশবকালে ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর প্রভাব এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক থেকে বিরত রাখার জন্য তৎপর থাকতে হবে।

সুতরাং সন্তান লালনপালন করার অন্যতম প্যারেন্টিং হলো ভালো মা হয়ে তাদের পরিচর্যা করা এবং ভালো মানুষ বানাতে সচেষ্ট থাকা। প্যারেন্টিং কৌশলে ভালো মা হতে উপরোক্ত টিপসগুলো অনুসরণ করা একান্তভাবে আবশ্যক। মনে রাখবেন, ভালো মায়ের সান্নিধ্য ও সার্বক্ষণিক সাহচার্য সন্তানদের ভবিষ্যৎ পথ চলার অনবদ্য পাথেয়। আগে ভালো মা হন, তারপর ভালো সন্তান লাভের আশা করুন। কারণ, লোককথায় বলে, মা গুণে ভালো সন্তান। ইংরেজি কথনে এমনটাই প্রকাশ পেয়েছে, ‘Life doesn't come with a manual, it comes with a mother.’

লেখক: অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা 

 

পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068669319152832