জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চাইলেন শাখা ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ হাসান ইমন। সাবেক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ ও নিরাপত্তা চেয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে উপাচার্য ও তার একান্ত সচিবকে ই-মেইলের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেন তিনি। ইমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী এবং শেখ রাসেল হলের আবাসিক ছাত্র।
ইমন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান করা আমার জীবনের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ। তাই ছাত্র জীবন শেষ করতে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে উপাচার্কে ই-মেইল (অভিযোগপত্র) করেছি। একই সঙ্গে আমার ওপর নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চেয়েছি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে জীবনের নিরাপত্তা ও নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে আবেদন’ শীর্ষক অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুব ইয়াবা সেবন করা অবস্থায় আমাকে মারধর করেছেন। সেই সঙ্গে আমার শরীরে মদ ঢেলে মাদকাসক্ত প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে ইমন অভিযোগপত্রে লেখেন- ৪ জন মিলে রড, হাতুড়ি দিয়ে অনবরত অত্যাচার চালিয়েছে আমার ওপর। একবার কাপড়ের ভেতর থেকে বের করা হলো পিস্তল। পেটে ঠেকানো হলো। ভয় কাঁপছিলাম, কারণ ইয়াবা সেবন করেই যুব ভাই পিস্তলটা বের করলেন। ভয় হলো মেরেও দিতে পারে। চোখ বন্ধ করলাম, গড়গড় করে পানি বেরিয়ে এলো চোখ থেকে, বাবা মায়ের কথা ভাবলাম। তাকে বললাম, ভাই আর পারছি না, পেটে গুলি করলে নাও মরতে পারি, মাথায় গুলি করেন। গুলি না করে পেটেই চাপ দিলেন নল দিয়ে। এদিক মার থেমে নেই। মাথায় হাতুড়ি, রড দিয়ে মার চলছেই।
ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতা উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম ও উপাচার্যের সচিব গৌতম কুমার বিশ্বাসকে ই-মেইলে পাঠানো অভিযোগপত্র ইমন দাবি করেন, বাংলা বিভাগের ৪১ ব্যাচের সাবেক ছাত্র আরমান খান যুব ও তার সহযোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে নির্যাতন চালিয়েছেন। যেখানে নির্যাতন শেষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল উপস্থিত হয়। একই সঙ্গে তার শরীরে পিস্তল ঠেকিয়ে ঘটনা প্রকাশ না করার হুমকি দেন যুব।
অভিযুক্তদের মধ্যে আরমান খান যুব ছাড়াও আছেন ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের মো. আরাফাত, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের তুষণ ও অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তি। কয়েক বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া অভিযুক্তরা মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষ এখনো দখলে রেখেছেন। বিষয়টি স্বীকার করে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক হুসাইন মো. সায়েম বলেন, হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকে, সে বিষয়টি জানি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে মারধরের ঘটনা আমি জানি না।
ইমন অভিযোগপত্রে ঘটনাপরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করেন, পরের দিনে গোসল করে ফ্রেশ হলাম। গেলাম প্রক্টরের কাছে। তিনি বাসায় ডাকলেন। বাসায় গিয়ে দেখি সোহেল ভাই সেখানে বসে আছেন।
প্রক্টর আমাকে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ দেননি। সোহেল ভাইয়ের সামনে তিনি আমার সঙ্গে কথা অব্যাহত রাখেন। তিনি জানতে চান, যুবর রুমে গেছিলা? কোনো প্রবলেম? বললাম, না। বাইরে অপেক্ষা করলাম। সোহেল ভাই বের হলে দাঁড় করিয়ে মারের দাগগুলো দেখিয়ে কাঁদলাম। বললাম আপনাকে কখনো বকিনি আমি।
বিচার চাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারপর চলে গেলাম এসআইের কাছে। এসআই মামলা ও অভিযোগ দিতে বলল। বললাম আমি ছাত্রলীগ, লাভ হবে না। আমি আস্থা পাচ্ছিলাম না। বাসায় এলাম, ভাবছি কী করব। যেখানে ক্যাম্পাসে অভিভাবক ভাবি যাদের, তাদের কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই, কেউ পাশে থাকবে না। আমি যেদিন মার খাই, হ্যালোসুনিশেনে পড়ে যাই।
যুবর বড়ভাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের বিষয়ে ইমন জানান, হঠাৎ মনে হয় আল নাহিয়ান খান জয় ভাইকে জানাতে পারি কারণ তিনি আমার পূর্বপরিচিত। কাটাবন টপটেনে জয় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সাতদিন সময় নেন ভাই। তিনি সমাধান দেবেন। সাতদিন আমাকে দূরে থাকতে বলেন। তিনি নিজেও লজ্জিত হয়েছেন জানান। আমি তার কাছে স্বাভাবিক জীবন ও নিরাপদ জীবনযাপন অনুরোধ করি। সাতদিন পর ফোন দিলেও আর ফোন ধরেননি। পরবর্তীতে মন খারাপ, হতাশা মানুষকে শেয়ার করতাম। সুইসাইড করার পদক্ষেপ নিয়েছি কয়েকবার।
প্রক্টরের প্রতি আস্থাহীনতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৩ আগস্টের ঘটনায় এতদিন পর আপনার কাছে আবেদন করছি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে জানানোর পরও তিনি আমাকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলেননি। উপরন্তু বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য তিনি পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে ঘটনার পরদিন প্রক্টর স্যারের বাসায় ছাত্রলীগ সভাপতির একান্তে বৈঠক, আমার কাছে প্রশাসনকে আস্থাহীন করে তোলে। প্রক্টরের ওপর আস্থা রাখতে না পারায় আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
ইমনের এই অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধরের বিষয়টি ইমন আমাকে অবগত করেছিল। কিন্তু লিখিত অভিযোগ দেয়নি। সে নিজেই বলেছে, বিষয়টি সে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে চায়। সে আমাকে বলেছিল, এ বিষয়ে সে নিজে থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবে।
অভিযোগপত্রের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সচিব গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, অফিস বন্ধ থাকায় কী ই-মেইল এসেছে তা জানেন না। তবে অভিযোগপত্রের একটি কপি এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।