এজেন্ট দিয়ে কর আদায়ের উদ্যোগের পাশাপাশি এখন ভ্যাট আদায়ও যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। ভ্যাট নেওয়ার মেশিন ‘ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি’ সরকারিভাবে বসানোর কাজে ব্যর্থতার পর এখন এই কাজ তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি খাতের জেনেক্স ইনফোসিস নামের এক প্রতিষ্ঠানকে।
জেনেক্স নিজের টাকায় ইএফডি মেশিন বসিয়ে কমিশনের ভিত্তিতে সরকারকে ভ্যাট আদায় করে দেবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাট আদায় করে ঢাকায় ৫২ ও চট্টগ্রামে ৫৩ পয়সা কমিশন পাবে। মেশিনের সফটওয়্যার তৈরি, নজরদারি, প্রশিক্ষণ ও প্রচারণাও চালাবে জেনেক্স।
এরই মধ্যে ৩ হাজার ইএফডি মেশিন দেশে এসে পৌঁছেছে। ধাপে ধাপে বাকিগুলোর আমদানির ঋণপত্র খোলাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও এগিয়ে চলছে। আগামী জুন মাসেই এ কার্যক্রম উদ্বোধনের লক্ষ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। আর জেনেক্স ইনফোসিস দ্রুত এ কাজ শুরুর দিনক্ষণ ঠিক করাসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করতে এনবিআরের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসছে।
এদিকে ভ্যাট আদায়ের কাজ বেসরকারি খাতে দেওয়ার ফলে ব্যবসায়িক লেনদেনের তথ্য বেহাত হওয়া বা তথ্যের কারসাজির প্রশ্ন সামনে এনেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও এনবিআর বলছে, এ রকম কোনো সুযোগ নেই।
তবে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ গতকাল সোমবার বলেন, ‘ভ্যাট আদায়ের কাজ এনবিআরের। এটা বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া মানে নতুন আরেকটি হয়রানি ও অনিয়মের জায়গা তৈরি করা। এটা না করে এনবিআরের উচিত অনেক প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দিয়ে একসঙ্গে বেশি বেশি ইএফডি বসিয়ে রাজস্ব আয়ে গতি আনা। নাহলে ভুল বার্তা যাবে।’
জানতে চাইলে এনবিআরের ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি বিভাগের সদস্য ড. মইনুল খান বলেন, ‘ভ্যাট আদায় বাড়াতে এখন ব্যাপক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সামনে আমরা আর সরকারিভাবে ইএফডি কিনে দেব না। এ কাজ আউটসোর্সিং করে দিচ্ছি। একটি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠান কাজটি পেয়েছে। তারা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টসহ যাবতীয় কারিগরি বিষয় প্রায় চূড়ান্ত করেছে। সহসাই আমরা তাদের মাধ্যমে ইএফডি বসিয়ে ভ্যাট আদায়ের কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করি। ইএফডির পেছনে যাবতীয় খরচও ওই প্রতিষ্ঠান করবে। এ জন্য তারা একটা কমিশন পাবে।’
জানা যায়, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি চাহিদা মেটাতে সরকার এখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বাড়াতে মরিয়া। আগামী অর্থবছরে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড খরচের বাজেট দেওয়া হচ্ছে। যেখানে রাজস্ব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এখন আয়ের প্রধান লক্ষ্য ধরা হচ্ছে আয়কর ও ভ্যাট খাতকে।
তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে আসছে অর্থবছরেই কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি নজরদারি করে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ই নতুন অর্থবছরের মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, জিডিপির হিসাবে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা হচ্ছে খুচরা পর্যায়ের লেনদেন। হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ধরা হলে আরও প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা যুক্ত হবে। কিন্তু বর্তমানের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের কারণে বিপুল রাজস্বের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে এনবিআর মনে করে। তাই সংস্থাটি উদ্ভাবনী ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রাজস্ব আয়ের পথ খুঁজছে বলে জানা যায়।
তারই অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের এজেন্ট নিয়োগ করে নতুন করদাতা খুঁজে তাদের করের জালে নিয়ে আসার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে আগামী অর্থবছরে।
অন্যদিকে, রাজস্বে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ভ্যাট খাতেও নেওয়া হয়েছে নতুন পদক্ষেপ। ভ্যাট আদায়ের একটি কাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসকে দেওয়া হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে সমঝোতা স্মারক সই হয়। পরে তাদের চূড়ান্ত কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
ভ্যাট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেনেক্স ইনফোসিসের ৩ হাজার ভ্যাট মেশিনের চালান দেশে এসেছে। সামনে আরও আসছে। আর আগামী জুন মাসে পরীক্ষামূলকভাবে মেশিন বসিয়ে ভ্যাট আদায় কাজের উদ্বোধন করা হতে পারে। মূলত যেখানে ব্যবসায়িক লেনদেন বেশি সে রকম স্থান, শপিং মল ও আইটলেটে এসব ইএফডি মেশিন বসানো হবে। জানা যায়, ভ্যাটের মেশিনে এমনভাবে সফটওয়্যার থাকবে, মাস শেষে এক ক্লিকেই ভ্যাটের রিটার্নও জমা দিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
জেনেক্স ইনফোসিসের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জুয়েল রাশেদ সরকার বলেন, ‘সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে ভ্যাট আদায় ও মাঠপর্যায়ে এর নজরদারিসংক্রান্ত সব কাজই আমরা করব। ৩ হাজার মেশিন চলে এসেছে। আমরা দ্রুত কার্যক্রম উদ্বোধনের ব্যাপারে কাজ করছি।’
তবে এ ব্যাপারে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে এনবিআরের সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় দোকানের বিক্রির তথ্য সংরক্ষিত থাকবে স্থাপিত এ মেশিনে এবং এনবিআরের সার্ভারে। ইচ্ছা করলে কেউ এর তথ্য মুছে ফেলতে পারবে না। আর বিদ্যুৎ বা নেটওয়ার্ক না থাকলেও এ মেশিন অফলাইনে তথ্যাদি নিজস্ব মেমোরিতে ধারণ করবে। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক ফিরে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে যাবে। জেনেক্স ইনফোসিস ব্যবসা ও বিক্রির লেনদেনের তথ্যের কারসাজি করতে পারবে না বলেও জানান কর্মকর্তারা।