‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ নামে একটি নতুন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এটি আবিষ্কার করা হয়। বিজ্ঞানীদের এই দলে আছেন বাংলাদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. লামিয়া আশরাফ মওলা। ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ একটি নবীন গ্যালাক্সির গঠন এখনো সম্পন্ন হয়নি। মহাবিশ্বের মোট বয়সের ৬০ কোটি বছর পর গ্যালাক্সিটির জন্ম হয়। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের সৌরজগতের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গা সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
গত বুধবার বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডলের কারণে এই গ্যালাক্সি দেখতে জোনাকির মতো। তাই গ্যালাক্সিটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’। এর মাধ্যমে প্রাচীন মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এই গবেষণার কাজে ড. লামিয়া মওলা ছাড়াও ছিলেন উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানের ২১ জন বিজ্ঞানী।
গবেষকেরা বলছেন, গ্যালাক্সিটি এখনো তার গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এটি বিগ ব্যাং–এর ঘটনার প্রায় ৬০ কোটি বছর পরে তৈরি হয়েছিল। ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ গ্যালিক্সির মোট ভর আনুমানিক আমাদের সূর্যের সমান ভরযুক্ত ১০ লাখ নক্ষত্রের সমান। এর পাশে আরও দুটি তুলনামূলক ছোট গ্যালাক্সি রয়েছে, যেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে—ফায়ারফ্লাই বেস্ট ফ্রেন্ড এবং ফায়ারফ্লাই নিউ বেস্ট ফ্রেন্ড।
এই গ্যালাক্সিটি ১০টি ঘন নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে আটটি মধ্যাঞ্চলে এবং দুটি এর সম্প্রসারিত বাহুতে অবস্থিত। এর প্রধান দৃশ্যমান অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ হলো সেই দূরত্ব যা আলো এক বছরে অতিক্রম করে, যেখানে আলোর গতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। সে হিসাবে ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ গ্যালিক্সির দৃশ্যমান অংশের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মাইল।
ড. লামিয়া মওলা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথটি মহাবিশ্বের ইতিহাসে খুব দ্রুতই গঠন হতে শুরু করেছিল, সম্ভবত ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের মতো একই সময়ে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো অন্য গ্যালাক্সিগুলো নবীন অবস্থায় কেমন দেখাত তা জানার সুযোগ করে দেয় এই পর্যবেক্ষণ। সিমুলেশন এবং পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা দেখতে পাই যে, ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের ভর সেই সময়ের (প্রাথমিক পর্যায়ের) নবীন আকাশগঙ্গার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এই পর্যায়ে গ্যালাক্সিটির ভর আমাদের বর্তমান আকাশগঙ্গার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার গুণ কম ছিল।
ফায়ারফ্লাই স্পার্কল গ্যালাক্সিটি ফায়ারফ্লাই বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ এবং ফায়ারফ্লাই নিউ বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে প্রায় ৪২ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এইসবগুলো গ্যালিক্স আমাদের আকাশগঙ্গা গ্যালিক্সি পুড়ে ফেলা যাবে। যেখানে আকাশগঙ্গার আড়াআড়ি দূরত্ব প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ।
গবেষণাপত্রের প্রধান সহ–লেখক কার্তিক আইয়ার বলেন, আমাদের আকাশগঙ্গা পূর্ণ রূপ পাওয়া আগে কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে অন্যান্য গ্যালাক্সির সঙ্গে মিলিত হয়ে এবং নতুন নক্ষত্রের জন্ম দিয়ে বড় ও বিকশিত হয়েছে। কিন্তু ফায়ারফ্লাই স্পার্কল এখনো বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে, সে অর্থে প্রাথমিক গঠনের স্তরেই আমরা এটিকে দেখতে পাচ্ছি।
ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের মতো মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম দিকের গ্যালাক্সিগুলো ঘন গ্যাসীয় মেঘের চুপসে যাওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয় বলে মনে করা হয়। বর্তমান তত্ত্ব ও সিমুলেশনগুলো ইঙ্গিত করে, বিগব্যাং অব্যবহিত মহাবিশ্বের চরম পরিস্থিতিতে গ্যাস থেকে কীভাবে তারকা গঠিত হয় তার কয়েকটি সম্ভাব্য প্রক্রিয়া থাকতে পারে।
কার্তিক আইয়ার বলেন, আমাদের বিশ্লেষণ প্রস্তাব করে, এই গ্যালাক্সিগুলো উচ্চ চাপ ও ঘনত্বের অঞ্চলে বৃহৎ তারকাপুঞ্জ গঠনের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে। এগুলোই পরে একত্রিত হয় বা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। এই তারকাপুঞ্জের রঙে সামান্য ভিন্নতা থাকে, এটিই নির্দেশ করে যে এরা একসঙ্গে গঠিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, বেশি উত্তপ্ত ও কম বয়সী তারকাগুলো অধিক নীল দেখায়, আর পুরোনো তারকাগুলো লাল বর্ণালী দেখায়।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশের দূরবর্তী বস্তুর ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে সুদূর অতীতে ফিরে দেখা সম্ভব হচ্ছে। কারণ আলোরও নির্দিষ্ট গতিবেগ রয়েছে। এই টেলিস্কোপটি এমন গ্যালাক্সিগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে, যেগুলো বিগ ব্যাংয়ের পর প্রথম কয়েকশ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়টিকে বলা হয় ‘মহাজাগতিক প্রাতকাল’! বিগ ব্যাং ঘটেছিল প্রায় ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটে।
ফায়ারফ্লাই স্পার্কল হলো বর্তমানে সময়ে পরিচিত প্রথম দিকের কম ভরযুক্ত গ্যালাক্সিগুলোর একটি। এ ধরনের গ্যালিক্সগুলো গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল ভরসম্পন্ন বস্তু—যেমন একটি গ্যালাক্সি পুঞ্জ—তার অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বলের কারণে এর পেছনে থাকা আরও দূরবর্তী বস্তু থেকে আগত আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। তখন পৃথিবী থেকে দেখলে এটি একটি প্রাকৃতিক বিবর্ধক কাচের (ম্যাগনিফাইং গ্লাস) মতো কাজ করে।
পর্যবেক্ষেণের সময় সামনের গ্যালাক্সি পুঞ্জ ফায়ারফ্লাই স্পার্কল থেকে আগত আলোকরশ্মিকে প্রায় ১৬–২৬ গুণ বিবর্ধিত করেছে, ফলে গ্যালাক্সিটিকে বিশদভাবে দেখা সম্ভব হয়েছে।
ড. লামিয়া মওলা বলেন, ফায়ারফ্লাই স্পার্কল থেকে আসা আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে ১৩ দশমিক ২ বিলিয়ন বছর সময় লেগেছে। তবে, যেহেতু মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারমান, তাই এই সময়ের মধ্যে গ্যালাক্সিটি আমাদের কাছ থেকে আরও অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। আমাদের গবেষণা বলছে যে, আমরা যদি গ্যালাক্সিটির বর্তমান অবস্থা দেখতে পেতাম, তাহলে হয়তো সেটি দেখতে হয়তো আমাদের মিল্কিওয়ের মতোই হতো। এই আবিষ্কার আকাশগঙ্গার শৈশবকাল কেমন ছিল তা জানার একটি বিরল সুযোগ করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ওয়েলসলি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (কাসা) অ্যাসোসিয়েট মেম্বার ড. লামিয়া মওলা। তিনি দেশের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ও এবং এ লেভেল পাস করে নিউরোসায়েন্সে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ওয়েলসলি কলেজ থেকে জ্যোতিপদার্থবিদ্যায় স্নাতক করেন লামিয়া। এরপর তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ২০২০ সালে ফেলো হিসেবে কানাডার ডানল্যাপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে কাজ করেন। লামিয়া জেডব্লিউএসটির কানাডিয়ান দলের সঙ্গে ২০২০ সাল থেকে কাজ করছেন।