মাত্র চল্লিশ বছর আগেও যে এলাকায় পানি ছিলো সহজলভ্য এখন তার অনেক স্থানেই পানির সংকট। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত: নিচে নামতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে অকেজো হয়ে পড়েছে সরকারি ডিপ টিউবওয়েল। এমন অবস্থা বাংলাদেশের উত্তরের ৫টি জেলার বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র এলাকায়।
সরকারের গবেষণা বলছে, বরেন্দ্রর ৪০ শতাংশ এলাকা রয়েছে উচ্চ পানির সংকটে।
কৃষিতে ব্যাপকভাবে মাটির নিচের পানি উত্তোলন আর সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়া -দুটো মিলিয়েই এই সংকট বলছেন গবেষকরা। কিন্তু এমন অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো?
রাজশাহীর তানোরে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম কামারপাড়া। সেখানেই একটি ডিপ টিউবওয়েলের সামনে কিছু মানুষের জটলা। তারা সকলেই এসেছেন পানি নিতে।
জটলার মধ্যে অবশ্য কোন পুরুষ নেই। সকলেই নারী। আছে কয়েকজন শিশুও।
সেখানেই দেখা হয় আদিবাসি নারী জাস্টিনা হেমব্রমের সঙ্গে। কোমরে বাধা মেডিক্যাল বেল্ট।
জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, বছরখানেক আগে পানি বহন করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান। আঘাত পান কোমরে। এরপরই চিকিৎসকের পরামর্শে কোমরে বেল্ট পরেন তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সিরিয়াল মেনে পানি সংগ্রহের পালা আসে জাস্টিনার। মাথায় পাতিল আর হাতের কলসে পানি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরেন তিনি।
তার পেছনে সঙ্গি হলেন পাড়ার অন্য বাসিন্দারাও। যাদের এই পানি সংগ্রহের যুদ্ধ চলে প্রতিদিন। রোদ-বৃষ্টি কিংবা ঝড়, মুক্তি নেই কোন কিছুতেই। এমনকি বাড়ির শিশুরাও অংশ নেন পানি সংগ্রহে।
জাস্টিনা হেমব্রম থাকেন তানোরের মাহলপাড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি খোলামেলা পরিবেশে কয়েকটি ঘর। যেগুলোতে আলাদা আলাদা পরিবার বাস করে।
একটি টিউবওয়েল থাকলেও সেটায় পানি ওঠে না বহুদিন। ফলে এখানকার সকলেই খাবার পানি আনেন দূরের ডিপ টিউবওয়েল থেকে। সেটা দিয়েই চলে রান্না, গোসল, খাওয়া থেকে শুরু করে শুরু করে সংসারের সকল কাজ।
সেখানে দেখা গেলো, বারান্দার সামনে চার বছরের ছোট্ট ছেলের শরীর ভেজা কাপড়ে মুছে দিচ্ছিলেন আরিফা খাতুন। জানালেন, গরমে কষ্ট পেলেও ছেলেকে প্রতিদিন গোসল করাতে পারেন না। পানি দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দেন।
বরেন্দ্র এলাকায় কৃষকদের বিশেষত: শুষ্ক মওসুমের বোরো ধানের জন্য নির্ভর করতে হয় সরকারি সংস্থা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডিপ টিউবওয়েলের উপর।
এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডিপ টিউবওয়েল থেকেও পানি নিতে পারেন কৃষকরা।
কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই পানি নিতে বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয় কৃষকদের। আবার চাহিদা বেশি হওয়ায় কোন কোন এলাকায় শেষ পর্যন্ত পানি পান না এমন কৃষকও আছে।
তাদেরই একজন তানোরের দবিরুল ইসলাম। জানালেন, চার বিঘা জমির দুই বিঘা আবাদ করেছেন, আর বাকি দুই বিঘা আবাদ করতে পারছেন না। কারণ পানি নেই।
দবিরুল ইসলামের মতোই এবছর ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মুন্ডুমালার আরেক চাষী মাইকেল।
রাজশাহীর তানোরে কৃষকসহ সকলেই বলছেন এখানে যে পানির তীব্র সংকট তার মূল কারণ মাটির নিচে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু এখানে পানি আসলে মাটির কতটা গভীরে?
তানোরের উঁচাডাঙ্গা গ্রাম। এখানে মাটির নিচে পানির স্তরের গভীরতা মাপার জন্য ডিপ টিউবওয়েলের পাইপ বসিয়েছে বেসরকারি একটি এনজিও।
সেখানে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে পানির গভীরতা মাপেন সাইমন মারান্ডি।
গেলো ২০শে এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঐদিন পানির নিম্নস্তর পাওয়া গেছে ১১৬ ফুট নিচে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে পানির স্তর ছিলো ১০৬ ফুট গভীরে।
অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছরে পানির স্তর নেমেছে ১০ ফুট।
সর্বশেষ সরকারের পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর জরিপে দেখা যায় বরেন্দ্রর ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়নই উচ্চ পানির সংকটে রয়েছে।
এমনকি ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় এখনকার সময়ে পানিসংকটাপন্ন এলাকার সংখ্যাও বেড়েছে।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাতেও বরেন্দ্র এলাকায় পানির গড় নিম্নস্তর নামতে দেখা গেছে। বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মাটির নিচে পানির গড় নিম্নস্তর ছিলো ৩৫ ফুট।
সেটা ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ৫১ ফুটে নেমে যায়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে পানির গড় নিম্নস্তর পাওয়া যায় ৬০ ফুট নিচে।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এসেও দেখা যাচ্ছে, পানির গড় স্তর ৭০ ফুটের নিচে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে কোন কোন এলাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেগুলোতে প্রায় দুইশত ফুট নিচেও পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক স্থানেই সরকারের বসানো ডিপ টিউবওয়েল পানির নাগাল না পেয়ে এখন বিকল অবস্থায়। এরকমই একটি গ্রাম আছে বাধাইর ইউনিয়নে। সেখানে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের বসানো একটি গভীর নলকূপ কয়েকবছর ধরেই বিকল। নলকূপ ঘরের তালা খুলে দেখা যায় সেখান থেকে ডিপটিউবওয়েলের যন্ত্রপাতি তুলে ফেলা হয়েছে। বিকল অবস্থায় পড়ে আছে পানির ত্রিমুখী তিনটি লাইন, সুপেয় পানির রিজার্ভার ইত্যাদি।
এখানকার অপারেটর মুস্তাফিজুর রহমান জানালেন, নলকূপের গভীরতা ছিলো ১১০ ফুট। কিন্তু পানি না পাওয়ায় নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে।
যদিও বরেন্দ্র এলাকায় সামগ্রিকভাবেই ৪০ বছর আগে খুব সহজেই পানি পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেটা কেন পাওয়া যাচ্ছে না? এর উত্তরে কয়েকটি কারণ বের হয়ে আসছে।
এক. বরেন্দ্র এলাকায় নব্বইয়ের দশকের আগেও মূলত: একটি ফসলের চাষ হতো। সেটা হলো আমন ধান। কিন্তু নব্বই দশক থেকে ব্যাপকভাবে তিন ফসলের চাষ শুরু হয়। এই চাষাবাদের পুরোটাই আবার বলা যায় ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর। বোরো চাষে পানির প্রয়োজন আরও বেশি হয়। সবমিলিয়ে চাষাবাদের জন্য ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলন শুরু হয়।
দুই. বরেন্দ্র এলাকার গবেষকরা বলছেন, দেশের অন্যান্য এলাকার গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরে তথ্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান একটি গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণায় তিনি তথ্য দিচ্ছেন, আশি এবং নব্বই দশকের তুলনায় এর পরের দুই দশকে বরেন্দ্রর পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলোতে গড় বৃষ্টিপাত কমে গেছে ৪০০ মিলিমিটার। একদিকে পানির উত্তোলন বেড়েছে অন্যদিকে বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটির নিচে পানির পূনর্ভরণ হয়নি। ফলে পানির স্তর আরো নিচে নেমেছে।
তিন. আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকার মাটি উঁচু। অন্যদিকে একে ঘিরে থাকা নদীগুলো তুলনামূলক নিচে। ফলে মাটিতে বৃষ্টির পানি নিচে নামলেও সেটা ভূ-অভ্যন্তরভাগ দিয়েই দ্রুত গড়িয়ে নদীর নিচে চলে যায়। এছাড়া নদী-নালা-খাল শুকিয়ে যাওয়ায় সেগুলোতেও পানি জমে থাকে না। বিবিসি অবলম্বনে