রামমোহন রায় বাংলা লেখা শুরু করার আগেই বাংলা গদ্য বেশ এগিয়ে গিয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাতে। এসব পণ্ডিতের মধ্যে উত্তম গদ্য লিখেছেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। কারো কারো মতে, বিদ্যাসাগরের পূর্বে শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। তাহলে বাংলা গদ্যে রামমোহনের স্থান কোথায়? তাঁর পূর্ববর্তী গদ্যকারদের সঙ্গে তাঁর একটি তফাৎ হলো, তিনি গদ্য লিখেছেন ধর্মীয় ও সামজিক দায়বদ্ধতা থেকে। এই দায়বদ্ধতা তাঁর রচনার বিষয়বস্তুতে যেমন অভিনবত্ব এনেছে তেমনি ভাষা ও রচনাশৈলীতেও এনেছে নতুনত্ব। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা বাংলায় পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলেন ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্য। কিন্তু রামমোহন বাংলা লিখেছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর বক্তব্য প্রচার করার তাগিদে। তিনি বাংলা ভাষায় যুক্তিনির্ভর ও দার্শনিক বিষয়ের আলোচনা সূচনা করেন এবং বাংলা গদ্যকে সর্বসাধারণের ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলেন। বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যকরণ রচনার কৃতিত্বও রামমোহনের। রবীন্দ্রনাথের মতে, রামমোহন রায়ই ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যের ভূমিপত্তন’ করেন।
রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিধবাবিবাহের পক্ষে ও বহুবিবাহের বিপক্ষে শাণিত গদ্য লিখেছেন। বাংলা ভাষায় পলেমিক্যাল রাইটিং বা যুক্তিতর্কমূলক রচনার সূত্রপাত করেন রামমোহন এবং তার বিকাশ ঘটে বিদ্যাসাগরের হাতে। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কীর্তি বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের উপযুক্ত ভাষায় পরিণত করা। যে বঙ্কিমচন্দ্র নানা বিষয়ে বিদ্যাসাগরের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তিনিও লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে এরূপ সমধুর বাঙ্গালা গদ্য কেহই লিখিতে পারে নাই, তাঁহার পরেও পারে নাই।’ বিদ্যাসাগরের কয়েক পৃষ্ঠার আত্মজীবনী বিদ্যাসাগরচরিত-এ চোখ বুলালেই বোঝা যায় তাঁর হাতে উনিশ শতকেই বাংলা গদ্য কেমন ঝরঝরে প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছিল। এ-কারণে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।’
উনিশ শতকের বাংলায় নারীর প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের প্রথম দৃঢ় কণ্ঠটি রামমোহনের। ‘প্রবর্তক নিবর্তকের সম্বাদ-এ নারীর প্রতি সমাজের আচরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের যুক্তি ও ভাষা অশ্রুতপূর্ব। সহমরণ সমর্থনকারী প্রবর্তক স্ত্রীলোককে ‘অল্পবুদ্ধি’, ‘অস্থিরান্তকরণ’, ‘বিশ্বাসের অপাত্র’ ইত্যাদি বলে উল্লেখ করলে তাঁর জবাবে সহমরণবিরোধী নিবর্তকের জবাব, ‘স্ত্রীলোকেরা শারীরিক পরাক্রমে পুরুষ হইতে প্রায় ন্যূন হয়, ইহাতে পুরুষেরা তাহারদিগকে আপনার হইতে দুর্বল জানিয়া যে যে উত্তম পদবীর প্রাপ্তিতে তাহারা স্বভাবত যোগ্য ছিল। তাহা হইতে উহারদিগকে পূর্ব্বাপর বঞ্চিত করিয়া আসিতেছেন। …
‘স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোনকালে লইয়াছেন যে তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?
‘বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্দ্ধ অঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময়ে পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহার করেন। … স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে।’৩
এখানে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে রামমোহন শাস্ত্রের কাছে যাচ্ছেন না, যাচ্ছেন যুক্তির কাছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মমতা ও ভণ্ডামি অনাবৃত করছেন। বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগ আইনে বিধবা নারী মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী না হওয়ার বিধানকে রামমোহন অন্যায় এবং শাস্ত্রসম্মত নয় বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, বিধবা নারীর স্বামীর সম্পত্তি না পাওয়া বাংলায় সহমরণ ও বহুবিবাহের আধিক্যের কারণ। তবে রামমোহন যুক্তি দিয়ে কথা বলার সময় যতটুকু প্রগতিপন্থী শাস্ত্র ধরে কথা বলার সময় ততটুকু নন। যেমন, বিধবা নারীকে স্বামীর চিতা থেকে বাঁচাতে তিনি শাস্ত্র থেকে নারীর ব্রহ্মচর্যের বা চির-বৈধব্যের বিধান খুঁজে বের করে প্রচার করেন। নারীর পুনর্বিবাহ তাঁর চিন্তায় স্থান পায়নি এবং বিধবাবিবাহকে তিনি শাস্ত্রসম্মত বলে মনে করতেন না। অপরদিকে বিধবা সম্পর্কে রামমোহনের এবং পরবর্তী সময়ের রক্ষণশীলদের যে অবস্থান ছিল (আজীবন ব্রহ্মচর্য) তার বিরুদ্ধেই ছিল বিদ্যাসাগরের লড়াই। রামমোহন প্রমাণ করতে চেয়েছিলেনে যে, স্বামীর মৃত্যুর পর সহমরণ নয়, ব্রহ্মচর্যই নারীর জন্য শাস্ত্রের বিধান আর বিদ্যাসাগর প্রমাণ করতে চান বিধবা নারীর পুনর্বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রে অনুমোদিত। বিধবা নারীর ব্রহ্মচর্য একটি অতি কষ্টের বিষয় স্বীকার করেও রামমোহন শাস্ত্রানুগত থেকে বিধবা নারীর ব্রহ্মচর্যের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর বিধবার এই ব্রহ্মচর্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তি আর আবেগ দিয়ে :
তোমরা মনে কর পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রী-জাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না। যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না। দুর্জ্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্ম্মূল হইয়া যায় … যে দেশে পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম্ম ও পরম ধর্ম্ম; আর যেন সে দেশে অবলা জাতি জন্ম গ্রহণ না করে।
হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।৪
অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে, রামমোহনের জন্য সহমরণ নিবারণই আশু কাজ ছিল। তখন বিধবাবিবাহের মতো বিষয় তুললে মূল দাবি আদায়ই হয়তো কঠিন হতো। তবে বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিষয় নিয়ে তখনই কথাবার্তা চালু ছিল এবং জনরব ছিল যে, রামমোহন বিলেত থেকে ফিরে বিধবাবিবাহ প্রচলন করবেন।
চার
উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক জাগরণের ও তার নায়কদের নিয়ে যে-কোনো আলোচনায় এই জাগরণের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। হিন্দু মধ্যশ্রেণির এই জাগরণের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ ছিল না। বাংলার মুসলমানের মধ্যবিত্তের সঙ্গেও এর যোগাযোগ ছিল নিতান্তই পরোক্ষ। তাই কলকাতায় ব্রিটিশ অনুগত মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে ইংরেজদের সহায়তায় যখন সাংস্কৃতিক জাগরণ বা ‘রেনেসাঁস’ চলছিল তখন ব্রিটিশ শাসক-জমিদার-নীলকরদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার হিন্দু-মুসলমান কৃষক-কারিগর ও আদিবাসী সম্প্রদায় দফায় দফায় বিদ্রোহ করছে। এসব বিদ্রোহের বিরুদ্ধে বাংলার জাগরণের নেতাদের ভূমিকা ছিল নির্লিপ্ততা না হয় বিরোধিতার। স্মরণ করা যেতে পারে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগে একসময় নকশালপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে অন্যদের সঙ্গে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভেঙেছিলেন।
রামমোহন ও বিদ্যাসাগর দুজনই নানাভাবে ব্রিটিশ শাসনের সুবিধাভোগী ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁদের ব্রিটিশ আনুগত্যের চরিত্রের মধ্যে ব্যাপক ফারাক ছিল। রামমোহন রায় প্রথম জীবনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারের ব্যবসা করে এবং ব্রিটিশদের সুদে টাকা ধার দিয়ে প্রচুর বিত্তশালী হন এবং সেই অর্থে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারি কেনেন। ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াও নিবিড় সখ্য ও কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে ‘কমার্শিয়াল অ্যান্ড প্যাট্রিওট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে মূলত কলকাতার শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের তৈরি একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদের রামমোহন সদস্য ও যুগ্ম-কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ৫ কলকাতার ইংরেজ সমাজে রামমোহন রায় একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন এবং ইংল্যান্ডেও তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় হিসেবে যথেষ্ট মর্যাদা লাভ করেন।
রামমোহন ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে কেবল ঈশ্বরের আশীর্বাদই মনে করতেন না, তিনি মনে করতেন, ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে ভারতের অনেক সমৃদ্ধি হবে এবং ভারতবাসী ইউরোপীয়দের মতো সভ্য জাতিতে পরিণত হবে! রাডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর বহুল বিতর্কিত ‘ডযরঃব গবহ’ং ইঁৎফবহ’ কবিতায় বলেছিলেন যে, বিজিত উপনিবেশের ‘অসভ্য’ ‘বন্য’ মানুষদের সভ্য করার দায়িত্ব শ্বেতাঙ্গদের। উপনিবেশের বাসিন্দা হলেও এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ একটি দৃষ্টিভঙ্গি রামমোহনও পোষণ করতেন। তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন; কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ অধীনতায় কোনো সমস্যা দেখেননি! ফরাসি প্রকৃতিবিদ ভিক্তর জ্যাকেমোঁকে তিনি বলেছিলেন :
বিজিত দেশের মানুষের তুলনায় বিজয়ী দেশের মানুষ যদি অধিক সভ্য হয় তবে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশ জয় করার দোষের কিছু নেই। কারণ বিজয়ীরা বিজিত দেশের মানুষের নিকট সভ্যতার সুফল নিয়ে আসে। ভারতের আরও বহু বছর ইংরেজের অধীনে থাকা প্রয়োজন যাতে ভারত যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফেরত চাইবে তখন তাকে অনেক কিছু হারাতে না হয়।৬
এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি ইউরোপীয়দের ভারতে জমিজমা কিনে স্থায়ী বসতি স্থাপনের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ইউরোপীয়দের সঙ্গে ভারতীয়দের সংশ্লিষ্টতা যত বেশি বাড়বে ভারতের সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তত উন্নতি হবে। নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার চাষীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও রামমোহন-দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিরা মনে করতেন, নীলচাষে দেশের উপকার হচ্ছে। তাঁরা নীলকরদের প্রশংসা করতেন। রামমোহনের পত্রিকা সম্বাদ কৌমুদিতে নীলকরদের সমালোচনা খণ্ডন করে প্রবন্ধ লেখা হতো।
লেখক : প্রাবন্ধিক