দৈনিকশিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত সকল পর্যায়ের আদালতেই বিচারকের স্বল্পতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিচারকের স্বল্পতার কারণে দিনের পর দিন মামলাজট বেড়েই চলেছে। মামলাজট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এটা করা সম্ভব হলে মামলাজট কমিয়ে তা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছে আইন কমিশন। একাদশ সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে গত বছর এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
কমিশন বলছে, সমগ্র বিশ্বের বিচারব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বিচারকের অনুপাত বিদ্যমান মামলার তুলনায় খুবই স্বল্প। বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। এই বিপুলসংখ্যক মামলা পরিচালনার জন্য বিচারকের সংখ্যা অতি নগণ্য। দেশে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারক মাত্র এক জন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৮৬ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার জন, অষ্ট্রেলিয়ায় ২৪ হাজার ৩০০ জন, ভারতে ৪৭ হাজার ৬১৯ জন এবং পাকিস্তানে ৫০ হাজার জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা এক জন। এই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে দেশে মামলাজটের অন্যতম প্রধান কারণ বিচারকের নগণ্য সংখ্যা।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। কমিশনের অপর দুই সদস্য হলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর।
গবেষণা প্রতিবেদনে কমিশন বলছে, বিদ্যমান বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও নানা রকম পারিপার্শ্বিক কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। একই বিচারককে নিজস্ব আদালতের বাইরে অনেক সময় একাধিক আদালতে বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক সময় ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে থাকে। সাধারণ জনগণের আস্থা কমতে থাকে বিচার বিভাগের ওপর।
এভাবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, যার প্রভাব সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের ওপর পড়ে। এছাড়া ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বছরে বছরে মামলা সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত ১৫ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এই অস্বাভাবিক মামলাজট নিরসনের ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের শুধু আস্থাই হারিয়ে যাবে না, বরং বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। এজন্য রাষ্ট্রের সীমিত সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প সময়ে ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব নয়। অধিকসংখ্যক বিচারক একসঙ্গে নিয়োগ করলে তাদের গুণমানের অবনতি ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। তবে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০০ বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।যেসব কারণে বাড়ে মামলাজট
মিথ্যা, ফলহীন ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের, জনবলের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, আদালতসমূহে মামলার সুষম বণ্টনের অভাব, প্রশাসনিক শৈথিল্য, অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জবাবদিহির অভাব, আইনজীবীগণের আন্তরিকতার অভাব, দুর্বল মামলা ব্যবস্থাপনা, জমিজমাসংক্রান্ত কাগজাদি সংরক্ষণের অভাব, প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যাবহারিক জটিলতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, ক্রমাগত শুনানি না করা, নকল সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম, উচ্চ আদালত কর্তৃক নথি তলব হওয়া, সংশ্লিষ্ট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে বিলম্বজনিত দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ মামলাজটের কারণ। প্রতিবেদনে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে কমিশন।